অকালে হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখগুলো মনে পড়ে, বেলা অবেলায়

এপ্রি ২৭, ২০২৩

মাত্র ক’দিন হল, আমাদের স্কুল জীবনের বন্ধু জহির চলে গেল । রেখে গেছে একটিমাত্র কন্যা । তাও মাতৃহীন । শৈশবে সোনার চামচ নিয়ে বড় হওয়া ছেলেটি বড় দারিদ্র্যে শেষ দিনগুলো পার করেছে । বন্ধুদের অকাতর সহযোগিতা তার কষ্ট কিছুটা লাঘব করলেও চলে যেতে হয়েছে বড্ড অবেলায় । তাকে ডাকা হত ক্যাসিও জহির । কারণ সেই ৩৫ বছর আগেও , তার বাবা ছিলেন ক্যাসিও ব্রান্ডের বাংলাদেশে সোল ডিষ্ট্রবিউটর । প্রাচুর্য্য থাকেনি শেষ অবধি । কাতারে বহু বছর বিলাস ব্যসনে কাটিয়ে ফিরেছিল শেষ দিনগুলোতে রিক্ত হাতে । আমাদের স্কুল বন্ধু ডাঃ রজত, সৌদী প্রবাসী ডাঃ ফখরুল, প্রবাসী বন্ধু ক্যাপ্টেন বিমান , নিমু , সাগর এবং নাম না বলা আরো বন্ধুদের অকৃপণ হাত কিছুই রক্ষা করতে পারেনি জহিরকে সময়ের করাল গ্রাস থেকে ।

মনে পড়ে বিশ্বজিৎ মজুমদার (টিটু)। আশির দশকে খাতুনগঞ্জের অন্যতম শীর্ষ ধনী বাবার বড় ছেলে মিঠু দা ছিলেন আমাদের স্কুলের সিনিয়র । বড্ড নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় । তাঁর ছোট ভাই আমাদের বন্ধু টিটু । দরাজ হাত ছিল তার । বন্ধু অন্ত প্রাণ । যে আমলে ব্যক্তিগত গাড়ি খুব সুলভ ছিল না, সে আমলেও টিটু ঘুরে বেড়াত নিজের গাড়িতে । বড় ছেলের মৃত্যুর পর , টিটুরা চলে যায় কোলকাতা । বহু বছর পর ওর সাথে দেখাও হয় । কথা আর ফুরোয় না । হঠাৎ বন্ধু বিমানের সাথে আলাপে শুনি টিটু আর নেই । অবেলায় চলে যাওয়া বন্ধু টিটু ক্রীড়ামোদী ছিল । ভালবেসে বিয়ে করেছিল । জানিনা কেমন আছে তার স্ত্রী ও সন্তান ?

মিছিলে মিটিং এ একদিন পরিচয় হয়েছিল আমার চেয়ে একটুখানি বয়েসী বন্ধু কানু বরণ দত্তের সাথে । জীবন যৌবন সমর্পিত সমাজ বদলের সংগ্রামে । খেলাঘর, যুব ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি তার ধ্যান জ্ঞান । ছাত্র ইউনিয়ন কি করে বাড়ানো যাবে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, সাংস্কৃতিক সংগঠন এর পরিসর কি করে বড় করা যায়? সেটাই তার সর্বক্ষণের চিন্তা । বিয়েও করলেন দেরীতে । ছাত্র পড়িয়ে পেট পিঠ চালান । চলছিল সব ভালোই । আগস্ট ২০০৭ ছাত্র বিদ্রোহ তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে । কার্ফ্যু ছিল রাতভর । বেশ ক’দিন । ভোর হতেই শুনলাম কানু নেই । আমি তখন চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়নের সভাপতি । শুনেই ছুটলাম। পড়ি মরি করে । পৌঁছলাম যখন তাঁর বাড়ি, তখন চিতার আগুন নিভে এসেছে । কাউকেই কিছু বুঝে উঠতে না দিয়ে চলে গেল কানু ।

আমাদের এক স্কুল বন্ধু ছিল । নাম গোলাম রাব্বানী । স্কুল পেরিয়ে তার সাথে আর দেখা হয়নি । পেশাগত জীবনে মেরিনার হয়েছিল। হঠাৎ শুনি রাব্বানী আটক। ফিলিপাইনের মুসলিম গেরিলা বিদ্রোহীদের জন্য জাহাজ ভর্তি অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল । আটক হয়ে গেল । ফিলিপিন্স সরকারের নৌসেনাদের হাতে । আর জানিনা তার খবর । বড্ড সিধা সাপ্টা ছিল । আজ আর জানিনা তার খবর । আমার বন্ধুরা কি কেউ জানে ?

যতটা বন্ধু, তার চেয়েও বড় ভাই। আমার সাথে ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি মিলাদ ভাইয়ের, বন্ধু মুহিবের ভীষণ ঘনিষ্ট । ডালিম ভাই । লালখানবাজার হীরামন খেলাঘর এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । কাপ্তাই সুইডিশ পলিটেকনিকে পড়তেন । কারিগরী ছাত্রদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন । ওদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । জীবনে বেঁচে থাকার চেষ্টায় গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে । হঠাৎ বলা নেই , কওয়া নেই। জানা গেল ডালিম নেই । ফিরছে তার মরদেহ । আমার চোখে ভাসে আজো, জলের মত অশ্রু বইছে মিলাদ ভাইয়ের। ডালিম এর পরিবারের সদস্যদের মতই বুকফাঁটা আর্তনাদ মিলাদ ভাইয়ের । ভীষণ মর্মন্তুদ । আজো ভাসে । আজো ।

ভুলিনি বন্ধু কায়সার কায়কোবাদ কাঁকন । ওর ছোট ভাই আমজাদ আমার একই পেশার লোক । সেও আমার বন্ধু । তাঁরো ছোট ভাই এখলাসুর রহমান আবু আমার সাথে ছাত্র ইউনিয়ন ও করেছে কিছুকাল । যুব ইউনিয়ন করেছে বহু বছর । কাস্টমস্ ইনস্পেক্টর মতিউর রহমান ( যদি স্মৃতি প্রতারণা না করে) সাহেবের ছেলে । একজন অমিত সম্ভাবনাময় তরুণ ছিল কায়কোবাদ । ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর এত বড় সংগ্রহ আমি আজো খুব কম দেখেছি । কায়কোবাদের বাসায় সেই ৮৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের সকল রচনা সমগ্র সহ অন্ততঃ কয়েক হাজার বই দেখেছি। আগ্রাবাদ বহুতলা কলোনীতে ছিল ওদের বাসা । ঐ বাড়ির ৮ ছেলে । সম্ভবতঃ । সকলেই পড়ে । কায়কোবাদ পড়ে আর গিলে । শৈশব থেকেই ছিল রিউম্যাটিক ফিভার এর রোগী । পড়ে আর লিখে । মেডিক্যাল এর ভর্তি পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে এসেছিল অসহ্য তীব্র যন্ত্রণায় । শারীরীক কষ্ট নিয়ে । ইয়ার গ্যাপ হয়ে গেল । তবুও কায়কোবাদ ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে । ওঁর বাসাতেই আমার হুমায়ুন আহমেদ চেনা । পাঠ । দিন, মাস, বছর রিউম্যাটিক ফিভার এর সাথে লড়াইয়েল যবনিকা নামে। কায়কোবাদ পরাস্ত হয় । সেদিন আমরা “এক বিষয়ে তিন বই” এর প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওয়ের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিলাম । আর ঘেরাও শেষে গিয়েছিলাম বন্দর ( পূর্ব) কলোনীতে তাঁর কবরের কাছে । কায়কোবাদ এর একটি বই বেরিয়েছিল পরে ।

জালাল ভাই ঠিক আমার প্রচলিত অর্থে বন্ধু ছিলেন না । দেখা হত অনেক অনেক দিন পর । বছর বছর যোগাযোগ ও থাকত না । তবুও কোন কোন মানুষের সাথে অচ্ছেদ্য অমোঘ বন্ধন ঘটে যায় । থেকে যায় । মাঝে ভারতীয় ভিসা ছিল জটিল ও সময় সাপেক্ষ । জালাল ভাই বললেন, চট্টগ্রাম এসে ভিসা নেবেন । বললাম, আসুন । বেশ দেরীতে বিয়ে করলেন । তাও জানালেন । সিলেটের কোন প্রগতিশীল সংগ্রাম । মানে, সাথে আছেন জালাল ভাই । আমার ছেলে বন্ধুদের সাথে সিলেট যাবে । তাকে ইমার্জেন্সী ফোন নম্বর দিলাম জালাল ভাইয়ের । জালাল ভাইকে বললাম। তিনি দিলেন, আরো দুজনের নম্বর । যদি লাগে । আমেরিকা থেকে ফিরছিলাম সেদিন । গেল অক্টোবর । মাটিতে নেমেই শুনলাম তাঁর চলে যাওয়ার সংবাদ ।

নিজের শরীরেই বাসা বেঁধেছে কত শংকা । হৃৎযন্ত্র বিগড়েছে ৩ বছর হল । ওপারের ধ্বনি কানে বাজে কতবার । যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ , লড়েই যাচ্ছি । বলা নেই , কওয়া নেই মা চলে গেছেন ২০১৪ তে । বাবা ও তাঁর পিছে হেঁটে গেছেন । আমার মা’ এর পরে যে নারী, সম্পর্কে আমার শ্বাশুরী পুত্রবৎ স্নেহ দিয়েছিলেন, তিনি ও চলে গেছেন । কত্ত অবেলায় চলে যাওয়া দেখেছি, আমার স্ত্রীর ছোট ভাই মণি’র । ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে পা ভেঙে বিছানায় । ৬/৭ বছর বিছানায় কাটিয়ে এক্কেবারে শেষ শয্যায় । কত্ত অল্প বয়েসে দেখেছি বুয়েটে ভর্তি হওয়া , দারুণ সুন্দর সাজ্জাদ ভাইয়ের পুকুরের জলে হারিয়ে যাওয়া ।

মৃত্যুর দৃশ্য , মৃত্যু আমার বড্ড অসহ্য লাগে । ভাল লাগেনা । পীড়া দেয় । বেদনায় ভাসায় । যে ব্যবসায়িক সংগঠনের সাথে আছি, এইখানে প্রতিটি সদস্য অথবা তাঁদের নিকটজনের মৃত্যু সংবাদ দেয়া হয় । আমি প্রায়শঃ সন্তর্পণে সে ম্যাসেজ দেখি । যদি ভেসে আসে আবার কোন বিয়োগ !

তবুও এই সত্য । জীবনের মত মৃত্যুও ।

” চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় ” , তবুও আমাকে প্রস্থানের বেদনা বিদ্ধ করে । মৃত্যুচিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে। পীড়িত করে । আমার জাগরণে কিংবা জেগে থাকা বেলায় চেনা মুখগুলো ফিরে ফিরে আসে । আমি ওদের নিয়ে , ওদের সাথে বসত করতে ভালবাসি।

মার্চ ২৩, ২০১৯