“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে “

এপ্রি ২৪, ২০২৩

“ডারউইন যেমন জৈব প্রকৃতির বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানুষের ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম ” – মার্কস এর সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে অসাধারণ এক বক্তৃতায় এঙ্গেলস এভাবেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। প্রকৃতি জগতে ( মানুষ ও প্রকৃতির অংশ) বিকাশের যে সকল গবেষণা এ অবধি আবিষ্কৃত এবং উন্মোচিত হয়েছে , তা বারেবারেই নতুন নতুন গবেষণা ও গবেষণা লব্ধ ফলাফল এর মধ্য দিয়ে আরো ঋদ্ধ হয়েছে । পুরনো ধারণা ও নতুন চিন্তার সংশ্লেষ এক অবিরাম প্রক্রিয়া । কাজেই, ডারউইন এর চিন্তার অনন্যতা ও অসাধারণত্ব ডারউইন পূর্ব জমানার চিন্তার ধারাবাহিকতা এবং পুরনো চিন্তার জগত থেকে একই সাথে উল্লম্ফনও । কিন্তু, ডারউইন প্রকৃতি বিজ্ঞানের শেষ সত্য , এভাবে প্রকৃতি বিজ্ঞানের কোন শিক্ষার্থী চিন্তা করেন না। এতদসত্বেও , প্রাকৃতিক নিয়ম প্রকৃতি জগতে যে পদ্ধতিতে কাজ করে , নানান ‘এক্স” ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিয়েও , সামাজিক বিজ্ঞান এর ক্ষেত্রে “নিয়ম” বলে বিবেচিত বা ধারণাকৃত নিয়মগুলো মোটেই প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর মত কাজ করেনা। প্রকৃতি জগতে এ অবধি জানা জ্ঞান মতে , মানুষ এমন একটি বুদ্ধিমান ও অগ্রসর সত্বা , তাঁকে প্রকৃতি জগতের অপরাপর সত্বার মত তুলনায় নেয়া চূড়ান্তভাবে যান্ত্রিক বিবেচনার অধিক হয়ে ওঠেনা । সুতরাং, জৈব প্রকৃতির নিয়ম প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর ক্ষেত্রে যতটা কার্যকর, সমাজ বিজ্ঞান এর ক্ষেত্রে তা নয় । মার্কস এর সমাধিস্থলে প্রদত্ত বক্তৃতায় , প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর জগতে ডারউইন এর আবিষ্কৃত নিয়ম ও মার্কস এর ইতিহাস এর বিকাশের আবিষ্কার নিয়ম এর মধ্যে সাদৃশ্য টানা তাঁদের চিন্তার অনুসারীদের মধ্যে রোপন করে অনড়, নিশ্চল চিন্তার বীজ এবং সেই নিয়ম এর ব্যাখ্যায় অনুসরণকারীরা যে কোন বিতর্কে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন ভয়ংকর শত্রুর মত ।

মার্কস এর চিন্তার শত্রু ও মিত্র মোটামুটি সকলেই একমত না হলেও, এ যাবৎকালে পুঁজিবাদের চক্রাকার সংকট , পুঁজির নির্মম শোষণ , উদ্বৃত্ত মূল্য, পুঁজিবাদের নিরন্তর দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়ে মার্কস এর গভীর পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার এর প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন । বস্তুতঃ তাঁর মৃত্যুর শতাব্দীকাল পরেও মার্কস বহু নন্দিত, নিন্দিত ও আলোচিত মানুষ । যেমনটি তিনি ছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়ও।

মার্কস এর চিন্তায় মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম এঙ্গেলস যেমন পূর্বোক্ত বক্তৃতায় বলেছেন “কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হলো সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয়।” ভিত্তি ও উপরিকাঠামো সংক্রান্ত তত্ত্ব আলোচনায় , মার্কসবাদীরা এই দুয়ের সম্পর্কের যত দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ করুক না কেন , চিন্তার আপেক্ষিক স্বাধীনতা এবং তার ক্ষমতায় মার্কসবাদীদের প্রমাণিত আস্থা অতি নগণ্য । অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রা তথা ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা নির্দিষ্ট উপরিকাঠামো, মার্কসবাদীদের চিন্তার জগতকে বেঁধে রাখে স্থান-কাল- ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ও বিশেষ সুনির্দিষ্ট অসামান্য জগত থেকে দূরে । রূপ নেয় তা বিশ্ববীক্ষা রূপে । মূর্তের মধ্যে বিমূর্ত খোঁজার সাধারণ প্রক্রিয়া অনন্যতা ও বিশিষ্টতাকে ধরা ও উপলব্ধিকে থমকে দেয় , কারণ “মূর্ত ” ধরা দেয় “সাধারণ” নিয়ম এর মধ্যে । সাধারণ এর অনিবার্য গতিতে আস্থা নিয়ে আসে চিন্তার জগতে নতুন “বিশ্বাসী” , অবিশ্বাস এর খোলসে ।

মার্কস তাঁর সময় এর বিকশিত পুঁজিবাদ এর স্বরূপ উন্মোচন এর চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন । তাঁর কর্ম প্রচেষ্টা হয়ে উঠেছিল যেন কর্মসাধনার। তিনি তাঁর জগতের সবচেয়ে বেশি তথ্য ও অভিজ্ঞতা নিয়েছিলেন প্রধানতঃ ইউরোপ থেকে । পুঁজির অনিবার্য সংকট যা তিনি উন্মোচন করেছেন, তা থেকে মুক্তির পথ ও তিনি নির্দেশ করেছেন, ব্যবস্থাটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিকাশের পর্যায়ে পুঁজিবাদ এর অনিবার্য পতন এর মধ্য দিয়ে । সকলেই জানেন, ইতিহাস সেভাবে এগোয়নি। পুঁজির কবর খনক শ্রমিকশ্রেণী আধুনিক ইউরোপে পুঁজিবাদ ধ্বংস করার কাজটি সম্পন্ন করতে পারেননি। তাঁর নিষ্ঠাবান অনুসরণকারী , যিনি চিন্তার জগতে মার্কস এর নামের সাথে নিজের নামটি স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি লেনিন । মার্কস এর চিন্তায় অদৃষ্টপূর্ব ” পুঁজিবাদ এর দুর্বল গ্রন্থি”তে যুদ্ধ ক্লান্ত সৈনিক ও শ্রমিকদের একাংশকে নিয়ে ক্ষমতা দখল করলেন । কিন্তু, সেদেশ তখনো কৃষিপ্রধান । শিল্প শ্রমিক মোট জনগোষ্ঠীর বিশ শতাংশের নীচে । সুতরাং, এরকম একটি দেশে মার্কস এর ভাবনার ” সাম্যবাদী সমাজের নিন্মতম পর্যায় ( যা সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত)” কিভাবে রচিত হবে , তা মার্কস উত্তর মার্কসবাদীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । শুধু রাশিয়া নয় , তৎপরবর্তীতেও সারা পৃথিবীতে যে কয়টি দেশে মার্কসবাদীরা ক্ষমতা নিয়েছেন , তার কোনটিই আধুনিক পুঁজিবাদী দেশ নয় , সবকয়টি অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ । সুতরাং, এই সব কয়টি দেশের মার্কসবাদী বিপ্লবীদের চ্যালেঞ্জ বস্তুতঃ উন্নয়ন ও বিকাশ এর চ্যালেঞ্জ । অনুন্নত শিল্পের সাথে বিশাল কৃষি খাত, এই উভয় ক্ষেত্রে “উৎপাদিকা শক্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে সর্বপ্রকার শোষণের উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ “সকল মার্কসবাদী বিপ্লবীদের জন্য প্রায় অভিন্ন সাধারণ চ্যালেঞ্জ । সেই সাথে পুরনো রাষ্ট্র যন্ত্র , রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার সুবিধাভোগী অনুসরণকারীদের তরফে চ্যালেঞ্জ তো সর্বক্ষেত্রে থাকেই । পাশাপাশি, বিশ্বজুড়ে অগ্রসর পুঁজিবাদী দুনিয়ার তরফে এই নতুন ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দেয়ার নানাবিধ চেষ্টা খুব হেলার বিষয় ছিল না ।

সাধারণভাবেই , লেনিনসহ মার্কসবাদী বিপ্লবীরা সকলেই নানা পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছেন। অনগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজির অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার তাগিদে ক্ষুদ্র ও নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যক্তি পুঁজিকে সুযোগ দিয়েছেন বিকাশের। কখনো ঢালাও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করেছেন । কৃষিতে কখনো জমির মালিকানা পুনর্বণ্টন, কখনো ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি উৎপাদন , কখনো ঢালাও যৌথায়ন এই সকল বিভিন্ন পরীক্ষণের চেষ্টা চালিয়েছেন। বলা বাহুল্য, বিপ্লববাদীরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এর কোন কোনটির পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন । বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ ভিন্ন পক্ষকে তাদের চিন্তা ও ভাবনার জন্য নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্ক ও শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে সঙ্ঘায়িত করতে চেয়েছেন । ফলতঃ সাধারণ ভাবেই, এই দ্বন্দ্বগুলো অবৈরী দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ থাকেনি । পরস্পরকে সবলে নির্মূল করতে চেষ্টা চালিয়েছেন। ট্র্যাজেডি হল, অবশেষে, প্রায় সব ধারাই শেষ অবধি উৎপাদনের সামাজিক ( রাষ্ট্রীয়) মালিকানার পথকে পরিত্যাগ করেছেন, ক্ষমতায় থেকে কিংবা পতিত হয়ে।

আজ দুনিয়া জুড়ে মার্কসবাদীরা সে অর্থে চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে চালকের আসনে নেই । তৃতীয় বিশ্বে অনুন্নত পুঁজি ও কৃষি নির্ভর দেশগুলোতে আজ জাতিগত বিকাশ, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, শিল্পের বিকাশ, কৃষি জমির পুনর্বণ্টন, কৃষির আধুনিকায়ন, বিকাশের
অপরাপর ক্ষেত্র উন্মোচন , রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ন, জবাবদিহিতা, নাগরিক অধিকার এর প্রশ্ন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । এ লক্ষ্যে “অপুঁজিবাদী” লেবেলে “পুঁজিতান্ত্রিক” বিকাশের কর্মসূচি নিয়ে মার্কসবাদী দলগুলো রুটিন কাজে ব্যস্ত । অথচ, অপরিমেয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ এর সাথে এরা পরস্পরের সাথে লড়াইয়েও রত। এই প্রশ্ন তাৎপর্যহীন নয় , যুগের পর যুগ তরুণ প্রজন্মের একাংশের অপরিমেয় আত্মত্যাগের পরও এঁদের জনসম্পৃক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা অনুল্লেখযোগ্য। তত্ত্বের কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ এই বামপন্থী মার্কসবাদীরা “তত্ত্ব সঠিক, প্রয়োগ ভুল “, ভিন্ন বামপন্থীদের ” সংশোধনবাদী” , ” ডান বিচ্যুতি “, “বাম বিচ্যুতি ” ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের অবিশ্রান্ত প্রয়োগে যতটা সিদ্ধহস্ত ততটাই ব্যর্থ নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলতে । এই রাজনীতি ও চর্চার বিপরীতে এঁদের আত্মজিজ্ঞাসা কখনো উন্মোচিত হতে দেখিনা । যে আত্মজিজ্ঞাসা বিশ্বজুড়ে মার্কসীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে জনগণের গণহারে প্রত্যাখ্যান এর কারণ অনুসন্ধানে এঁদের ব্রতী করবে। আদর্শকে বিশ্বাস এর পর্যায়ে উত্তরণ ঘটিয়ে, একদল ভক্ত অনুসারী দিয়ে আর যাই হোক, সমাজ এর বৈপ্লবিক মুক্তি কী সম্ভব? উন্নয়ন ও মানব মুক্তির দিশারী নিবেদিত মানুষের এই যাপন, সময় এর নিদারুণ অপচয়ের অধিক নয় । তত্ত্বের কঠিন খোলস ছেড়ে মুক্তিকামী মানুষের পথ অন্বেষণ এর জন্য চোখে বাঁধা মতান্ধতার কালো কাপড় অপসারণ জরুরী ও আবশ্যক বলে মনে হয় ।

যে কোন সমাজে কোন বিশেষ স্তরে , কোন বিশেষ পর্যায়ে বিকাশের পূর্ব নির্ধারিত পথ জানা থাকে না । আমাদের আলোচনার প্রথম অনুচ্ছেদে যা ব্যক্ত হয়েছে, সমাজ বিজ্ঞান এর নিয়ম প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এর জগতে যেভাবে প্রযুক্ত হয়, সেভাবে প্রযোজ্য নয় । কাজেই, নানাবিধ চিন্তা ও ভাবনার বহুস্রোত এর অস্তিত্ব সমাজে একটি নির্দিষ্ট সময়ে অস্বাভাবিক নয়। মতাদর্শিক চিন্তা যখন প্রবল বিশ্বাস এর রূপে পরিবর্তিত হয়, তখন এইসব চিন্তা ” মতাদর্শিক মৌলবাদ” এর রূপে আবির্ভূত হয় । মার্কসবাদীদের চিন্তা ও কাজের দীর্ঘ ইতিহাসে রুপকথাতুল্য অজস্র আত্মত্যাগের পরও এই প্রচেষ্টায় পুনঃপৌনিকতা খুব বেশি । জগতের আধুনিকতম দর্শন ও চিন্তার দাবী নিয়ে এই গোঁড়ামির কারণ এই চিন্তার ধারণার মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে থাকে । এই আবদ্ধ চিন্তার অর্গল খুলে দিয়ে আজ প্রয়োজন, মুক্তি অভিলাষী মানুষের বিচিত্র ও বহু বিস্তৃত চিন্তার ক্ষেত্র জুড়ে অজস্র জানা অজানা পথ ও পথের অন্বেষণ । মুক্তি যদি বাসনা হয়, তবে বৈপ্লবিক বা সংস্কারপন্থী কিংবা সংশোধনবাদী বা হঠকারী তা বিবেচনায় নিয়ে নয়, বিবেচনায় নিতে হবে মানুষের আরো এক কদম অগ্রগতির জন্য জরুরী কোনটি ? নিশ্চয়ই, অবিশ্রান্ত আত্মজিজ্ঞাসা এবং মানুষের কাছে যাওয়া । চিন্তকের চিন্তা নিঃসৃত বাণী নয় , মানুষের কাছে যাওয়া । মানুষের জন্য মঙ্গলময় ও কল্যাণ এর সর্বোত্তম পথ , মানুষের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া । এর বিকল্প তো দেখিনা।

কৃতজ্ঞতা : Masud Rahman