একটি চলচ্চিত্র উপভোগ ও অনুভব : Squid Game আধুনিক সমাজের Gladiator দের পরষ্পর বিনাশী লড়াই

এপ্রি ২৪, ২০২৩

নেটফ্লিক্সে এ যাবত কালে সবচাইতে বেশি সংখ্যক দর্শক দেখেছেন কোরিয়ান সমাজের পটভূমি ও চরিত্র নিয়ে গড়া এই মুভিটি। একটি সিজনের নয়টি পর্ব নিয়ে বানানো ছবিটির ব্যয় ২১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রথম চার সপ্তাহেই ছবিটি দেখেছেন ১৪২ মিলিয়ন দর্শক। বিশ্বব্যাপী ছবিটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। বলা হচ্ছে এ ছবি দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজের বর্তমান কালের প্রতিনিধিত্বশীল ছবি । কেউ কেউ একেই দুনিয়া জুড়ে পুঁজিবাদের বিপুল জৌলুশ অর্থ বৈভব এর হাতছানি ও তা অর্জনে প্রতিযোগিতারতদের পারষ্পরিক দ্বন্দ্ব -সংঘাত – পরষ্পরকে অতিক্রম এর জন্য জীবন বিনাশী রক্তাক্ত লড়াইয়ের ক্লেদাক্ত রুপ হিসেবে ও চিহ্নিত করেছেন।

ছবিতে প্রথম পর্বেই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলা সংলাপ ” Every person standing here in this room is living on blink of financial ruin. You all have debts that you can’t pay off.” ( এই কক্ষে সমবেত আপনারা সকলেই আর্থিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাদের সকলের যে ঋণ রয়েছে তা শোধ করার ক্ষমতা আপনাদের কারো নেই।) জীবনের নানান ঘটনা ও বিভিন্ন পর্যায়ে আপাত ব্যর্থ যে মানুষের সামনে বেঁচে থাকবার উপায়টুকু নেই, বাড়িওয়ালার বকেয়া ভাড়ার তাগিদা, ব্যাংকের ঋণ অনাদায়ের কারণে দেউলিয়া হবার দশা, মায়ের চিকিৎসা করতে না পারায় পা কেটে ফেলার ঝুঁকি, মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে দুঃসহ হয়ে ওঠা জীবন, মাথার উপর একটা ছাদ পেতে একটা ছোট ঘর সংকুলান করতে না পারার ব্যর্থতা, বড় কোম্পানিতে যৌবনের সবচেয়ে বড় সময় কাটিয়ে আকষ্মিকভাবে ছাঁটাই হয়ে বেকার হয়ে যাওয়া, ভাগ্যান্বেষনে পরবাসী হয়েও জীবনে চলার মত ব্যবস্থা করতে না পারা এমনি সব তথাকথিত ব্যর্থ (!) মানুষ বিপুল অর্থ পুরষ্কার এর আশায় নামে কয়েক পর্বের খেলায়। যে খেলায় পরাজিতের জন্য মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছুই নেই। মৃতদের সংখ্যা বাড়ে। বেঁচে থাকাদের পুরষ্কার এর অর্থ বাড়ে।

খেলার এক পর্বে বলা হয়, দশ জনের এক একটা দল গড়তে হবে। সকলেই চায় শক্ত সামর্থ্যদের দলে ভেড়াতে। বৃদ্ধ ও নারীদের কেউ দলে নিতে চায়না। এ যেন, কারখানার গতর খাটাতে তাগড়া যুবকের চাহিদা। বলা হয়, কোন পর্বে একজন করে সঙ্গী বেছে নিতে। সকলেই চায় সামর্থ্যবান সঙ্গী। দুয়েকজন ব্যাতিক্রম থাকেই। যখন বলা হোল, লড়াই করতে হবে সঙ্গীর বিরুদ্ধেই। অন্যথা করার উপায় নেই। কেউ কেউ মুষড়ে পড়ে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় হেরে সঙ্গীকে জিতিয়ে দেয়। কেউ কেউ আশ্রয় নেয় শঠতার। শুধু জিততেই বেপরোয়া হয়ে। মানুষের বিচিত্র ক্ষুদ্রতা- লোভ – শঠতার পাশাপাশি মানুষের অপরাজেয় মহত্ত্বের পরিচয় নানান চরিত্রে প্রকাশিত হয়। তবু, সব ছাপিয়ে পরষ্পরের বিরুদ্ধে লড়াই ছেড়ে দেয়ার উপায় থাকেনা। বলে রাখা ভাল, ছবির প্রথম পর্যায়ে প্রতিযোগীদের মধ্যে একটা বড় অংশ এই পরষ্পরের হন্তারক খেলা ত্যাগ করতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। ভোট হয়। খুব সামান্য ব্যবধানে অনিচ্ছুকরা বিজয়ী হয়। খেলা ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে দেয়া হয় সকলকে। কিন্তু, এ এক অবিচ্ছেদ্য ও অনতিক্রম্য জাল! ছিন্ন করা যেন অসম্ভব। দারিদ্র্য-অভাব- ঋণের ফাঁসে হাবুডুবু খাওয়া মানুষগুলোর সামনে বেঁচে থাকবার অন্য কোন উপায় থাকেনা। আবার, “যদি লাইগা যায়”! তবে অপেক্ষা করছে বিপুল পুরষ্কার। জীবন হন্তারক জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষেরা। পতঙ্গ যেমন আলো ঝলমলে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুনে। জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। তবুও ঝাঁপ দেয় মানুষ। যেন বা মানুষ নয়, সে হয়ে ওঠে কীটপতঙ্গ।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে রাজা বাদশাহ আমীর আর নাগরিক বিনোদনের জন্য বন্দীদের লড়াইয়ে নামিয়ে দেয়া হত তরবারী নিয়ে। কখনো পরস্পরের সাথে। কখনো হিংস্র পশুর সাথে। লড়াইয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে বেঁচে থাকার উপায় ছিল কেবলমাত্র প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। হোক সে সহবন্দী মানুষ, হোক সে হিংস্র পশু। তৎকালীন সভ্য সুশীলেরা নানাবিধ সুপেয় ও সুখাদ্য সহযোগে সে হিংস্র খেলা উপভোগ করতেন। পশুর নখর ও আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হতেন যোদ্ধারা। অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতারত যোদ্ধার তরবারিতে মাথার মুন্ডু খোয়াতেন। বিজয় মানে বেঁচে থাকা। লড়াইরত এইসব যোদ্ধাদের বলা হত গ্লাডিয়েটর। আনুমানিক ষষ্ট শতাব্দীতে গ্লাড়িয়েটরদের লড়াই বন্ধ হয়ে গেছে। গ্লাড়িয়েটররা ছিলেন দাস। না বলবার উপায় ছিল না তাদের। চয়েস ছিলনা তাদের। কিন্তু, আধুনিক বিশ্বের চিড়িয়াখানায় যেন বা আধুনিক গ্লাড়িয়েটর এই ছবির প্রতিযোগীরা । আপাত মনে হয়, স্ব ইচ্ছায় তারা অংশ নিচ্ছে। কিন্তু, খেলতে অনিচ্ছুকদের ৯৩ শতাংশের ফিরে আসা বুঝিয়ে দেয় তারা নিরুপায়। এই অনিচ্ছুক কিন্তু অনন্যোপায় অংশগ্রহণকারীরা Squid Game এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাবা বোর্ডের ঘোড়া বা সৈন্যদল এর অতিরিক্ত কিছু নয়। মোগল বাদশারা যেমন বিশাল দাবার বোর্ডে দাসীদের দাঁড় করিয়ে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতেন। ঠিক তেমনি অতিকায় পুঁজির যুগে বেঁচে থাকবার প্রবল আকুতি নিয়ে, স্বপ্নের মিঠাই মন্ডা খাবার প্রবল আগ্রহ নিয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সহযাত্রীদলের উপরে। যেখানে তার একই পরিণতি হবার সম্ভাবনা শতাংশের প্রায় নিকটবর্তী। আর এই খেলা দেখতে সমবেত হন কথিত ভিআইপি’রা। মজা নেন তারা। যারা হেরে যাওয়া মানুষের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির বিপুল লাভজনক কিন্তু গোপন ব্যবসা মুখোশের আড়ালে থেকে পরিচালনা করন।

এই ছবির প্রতিযোগী চরিত্রগুলো কেবল কোরিয়ান বাস্তবতায় নানাভাবে ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত মানুষের বেঁচে থাকবার জন্য ভেসে যাবার আগে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টারত মানুষের ছবিই নয়। বরং, দুনিয়ার এযাবতকালের ইতিহাসে, দুনিয়াতে সবচাইতে বেশি সম্পদ সৃষ্টি হবার পরও সারা দুনিয়াতেই সম্পদের বিপুল কেন্দ্রীভবনের ( পড়ুন কতিপয় এর হাতে সুবিপুল সম্পদের স্থানান্তরিত হওয়া) বিপরীতে বিপুল মানুষের জীবনে আরো অনিশ্চয়তা ও উৎকন্ঠার প্রহর গোণা মানুষের জীবনের বাঁচার লড়াই এবং হতাশার নান্দনিক প্রকাশ।