জলপাই জমানার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে তর্পণ

এপ্রি ২৪, ২০২৩

আমাদের রাতগুলো শুরু হত সাত তাড়াতাড়ি। সূর্য ডোবার পালা শেষে। একে একে ভরে উঠতে আসনগুলো। বেসুরো গলায় , হেঁড়ে গলায় গানের ভিড়ে কেঊ কেউ দারুণ সুরেলা গলায় মাতিয়ে তুলত। রাজনীতি – দেশ – প্রেম – জীবন যুদ্ধ – প্রতিদিনের সাতকাহন – ক্ষোভ বিক্ষোভ – কখনো পরচর্চা – সব ছাপিয়ে আগামী দিনগুলোর স্বপ্ন । কি ছিলনা ! চপ – কাটলেট – অমৃত তরল ভাসিয়ে নিত আমাদের। ‘হাওয়া ম্যা উড়তা যায়ে ” দিনগুলো সব।

ক্রমে ক্রমে আমরা বাঁধতে শুরু করি । নিজভূমের বাসিন্দা হতে থাকি। পেশার বাঁধন , সংসারের দায়িত্ব , জীবন যুদ্ধ ছিটকে দেয় আমাদের। কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ি। কেউ তর তর গতিতে এগুতে থাকে। না ঘরকা , না ঘাটকা হয়ে গুটিয়ে যায় কেউ কেউ। রবি কবির হাত ধরে কেউ , কেউ সওয়ারী হয় জীবনানন্দের সোনালী চিলের । আহা । কি যে সব মধুমাখা দিন ! মধুময় রাত। ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে এক দৌঁড়ে কক্সবাজার। মন চাইল বলেই মাঝরাতে পতেঙ্গা। মাত্র ক’জনার গাড়ি তখন । ‘জীবন মৃত্যূ পায়ের ভৃত্য’ করে স্পীডোমিটারের সর্বোচ্চ কাটায় গাড়ি চলছে। কখনো ঠাকুর , কখনো ফতেহ আলী খান , কখনো হেমন্ত কিংবা শচীনকর্তা। বেজেই চলেছে। রাত গভীরতর হয়। ফিরি আপনালয়ে। বন্ধনের গ্রন্থিগুলো ক্রমশ আলগা হতে থাকে।

সে এক সময় এসেছিল আমাদের জীবনে। এক চিলতে রোদ্দুর আনব বলে , শহরের এমাথা ওমাথা থেকে ঠিক ঠাক আমরা মিলিত হতাম। ৮ , দারুল ফজল মার্কেট। মাথার ওপর দিয়ে , মাথার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা শব্দগুলো মুক্তি , জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব , সমাজতন্ত্র , অধিকার , শিক্ষা , গণতন্ত্র সব যেন এক ঝটকায় এক ফুৎকারে টলমল করে ওঠে পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্ত এর ধাক্কায়। বার্লিন প্রাচীর ভাঙে। লেনিনের মূর্তি ভাংগে। খন্ড বিখন্ড সোভিয়েত। আর পুরানা পল্টনে দেয়াল ওঠে। যুক্তি সীমানা ছাড়িয়ে যা রুপ নিয়েছিল প্রায় বিশ্বাসের , চিঢ় ধরে , টলায়মান হয়। আস্থা হারানো মন নিয়ে পয়মন্ত সংসার আর জোড়া লাগেনি।

আমাদের যৌবনের নায়কেরা তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠে নিজেদের নতুন করে গড়তে। দেশ ছেড়ে দেশান্তরী হয় কেউ। এতকালের হিসেবের খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতা খুলেন কেউ। ভাঙা মন , ভাঙা হাট আজো বসে , সেই বাড়বাড়ন্ত আর নেই। যেন বা ইতিহাসের দায়মোচন। প্রাণবাজি রাখা মেধাবী তরুণ অগ্রসর হালের পথ অনুসরণ করে। নিজে বাঁচো! নিজে বাঁচাই তো জীবন! জীবনের গুপ্তিমন্ত্র পাল্টে যায় , কোন গুপ্ত রহস্যের হাতছানিতে।

তবুও মরাগাঙের নীচে বয় কোন চোরাস্রোত। ‘জীবন যেন দেই আহুতি মুক্তি আশে’ – একদা স্বপ্নের ভোর আনবে বলে যে তরুণ ছুটেছিল উদোম শরীরে কিংবা দিন ও রাতের ফারাক মুছে দিয়েছিল মরণপ্রাণ সংগ্রামে , থিতু হয়ে আসা সেইসব সোনাগুলো জীবনের নানাঘাটে পুড়ে পুড়ে আরো খাক হয়েছে। বুকের ভেতরে অন্তসলিলা সেই স্রোত কি আরো মৃত জীর্ণ হয়ে যাবে ? না , জীবনের অনন্ত তৃষায় জেগে উঠবে ? কে যোগাবে ভাষা ? কোথায় সে মহাপ্রাণ ?

জানো কি বন্ধু ?