“তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে॥”

এপ্রি ২৪, ২০২৩


জীবন বাজি রাখা দুরন্ত সময়

১০ নভেম্বর ১৯৮৭ । নূর হোসেন । বুকে – পিঠে শ্লোগান লেখা পোস্টার বয়। আজকের হাল জমানার ফ্যাশন আর বিপণনের পোস্টার বয় নয়। জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে পোস্টার করে তোলা নিজের শরীর । ঢাকা অবরোধ । বাসায় ক’দিন আগে থেকেই মা ও বাবার অনুরোধ । শাসন। কিছুতেই ঢাকা যাওয়া যাবেনা।

একরামুল হক আকবর । বয়সে আমার অল্প কিছু ছোট। ডবলমুরিং থানার তুখোড় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী। তার দৃঢ় প্রত্যয় । ঢাকা যাবেই । তখন সে এস এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে । তার বাবা বড় কঠোর মানুষ । নামকরা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার । তিনিও শাসিয়েছেন। ঢাকা যাওয়া যাবেনা। কিন্তু, সমুদ্রে পেতেছে যে শয্যা, শিশিরে কী সে ভয় পায়? আকবর ঢাকা যাবেই । সম্ভবতঃ ৮ নভেম্বর সকালে আকবরের সাথে আমার দেখা । আমিও অনুরোধ করলাম । ঢাকা যেওনা। এই আসন্ন পরীক্ষার সময় কাজটা ঠিক হবেনা ।সেও মুচকি হেসে মুখে জোর দিয়ে বলল, যাবেনা। ১০ নভেম্বরের আগেই এরশাদ সরকার নিজেই ট্রেন – বাস – লঞ্চ বন্ধ করে একপ্রকার ঢাকা আসার পথ সংকুচিত করল। আর ৮ নভেম্বর থেকেই নানাভাবে বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা ঢাকাগামী। সে আমলে মোবাইল নেই । ফোন খুব সুলভ নয়।১০ নভেম্বর চট্টগ্রামে ও মিছিল সমাবেশ হল। বিশাল । আকবরকে দেখিনা। ধারণা করে নিলাম, সে গন্তব্যে। সম্ভবতঃ ১৩ বা ১৪ নভেম্বর এর দিকে গুটি গুটি পায়ে ওর বাসায় গেলাম । সন্তর্পণে কড়া নাড়ি। বেশ খানিকক্ষণ পর ওর মা দরজা খুললেন । জিজ্ঞেস করলেন, “কী চাই ?” তাৎক্ষণিক উত্তর, হাতে থাকা কী যেন প্যাকেট এর দিকে নির্দেশ করে বললাম অবলীলায় মিথ্যা । “আকবর , কিছু নোট চেয়েছিল। ওগুলো দিতে এসেছি ।” দড়াম করে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে খালাম্মা বললেন, ” লাগবে না।” বুঝতে দেরী হলনা। ঘটনা গুরতর। আরো বেশ কিছুদিন পর আকবর এলো আমার বাসায়। শুকনো মুখে । জানলাম, ওর বাবা পিটিয়েছেন আস্ত লোহার রড দিয়ে । আকবর খুব সুঠামদেহী ছিল। এই মার ওর হজম করে সুস্থ হতে সপ্তাহ খানেক লেগেছে । সুস্থ হতে না হতেই আবার মিছিল । তখন প্রতিদিন প্রায় হরতাল । প্রতিদিন সমাবেশ আমতলায় । আবার পূর্ণোদ্যমে আকবর। ওর বড় ভাই মাহমুদুল হক বাবর ভাই ও ছাত্র ইউনিয়ন এর সক্রিয় নেতা ছিল। অল্প বয়সে সংসারী তখন। আকবর এর শিক্ষা জীবন স্বাভাবিক নিয়মে এগোয়নি । অনেক চড়াই – উৎরাই পেরিয়ে একটু দেরিতেই স্নাতক হয় সে।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর মিছিল। শাহজাহান হোটেল এর পাশে ডিলাইট বেকারী থেকে শুরু হয়ে ইসলামিয়া কলেজ পেরিয়ে দারোগা হাট গেট এর কাছাকাছি ।হঠাৎ শত শত পাথর ছুটে আসছে। মিছিল প্রায় ছত্রভঙ্গ । এক তরুণ এর হাতে বের হল পাইপগান। কিন্তু, গুলি আর একজনের কাছে। পাইপগান হাতে তরুণ ভীষণ ক্ষ্যাপাটে। মাথা গরম বলে খ্যাত আগে থেকেই । যাই হোক, ঘটনা হল মাসুদ আদনান সিদ্দিকীর সাথে সেদিন সকালে স্থানীয় জামায়াত নেতা রমজান আলীর কর্মীদের এক দফা কথা কাটাকাটি হয়েছিল। কোন এক ঘটনার রেশ ধরে । সে আঁচ করতে পারছিল , এর কাউন্টার এটাক হবে । তার আগেই সে এলাকায় মিছিল নিয়ে যেতে চেয়েছিল। জামায়াতের ত্রাসে থাকতে রাজী নয়। Masud Adnan Seddique এরপরও সকল সাহসী লড়াইয়ে ছিল ।

রাত তখন ২টা । জানুয়ারি ১৯৮৭। উপর্যুপরি ৫/৬ রাত চিকা মেরে ক্লান্ত মূল লিখিয়ে Ridwan-Shreen Chawdhury ভাই । ফেসি বিল্ডিং এর নীচে সিঁড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন । কমার্স কলেজ গেটের একপাশে Ayan Barua, অন্য পাশে আমি শখ করে লিখছি । আমার লেখা মাত্র শেষ হয়েছে। অয়ন বড়ুয়া তখনও লিখেছেন । “অস্ত্র নয় বই চাই, সন্ত্রাস নয় শিক্ষা চাই “। আকস্মিক ভাবে রাতের আঁধার ফুঁড়ে ২৫/৩০ জন দৌঁড়ে এল । “ধর ধর , মার মার ” বলে । কমার্স কলেজ হোস্টেলের দিক থেকে । আমরা মাত্র ৮/৯ জন । রং তুলি হাতে । নিরস্ত্র মানুষ । সবাই ছুটে চললাম । অয়ন দা পড়ে গেলেন । কিরিচের ১১টা কোপে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করল ছাত্র শিবিরের জানোয়াররা । কিছু দূর গিয়ে আমরা আবার একত্রিত হলাম । সবাইকে পাওয়া গেল । অয়ন দা কে নয় । অয়ন দা তখন সারা শরীরে রক্তাক্ত হয়ে রওয়ানা দিয়েছেন । তিনি প্রায় ১ কি.মি হেঁটে পৌঁছে গেছেন নিজের বাসার দরজায় । আমরা তাঁর বাসায় পৌঁছে জানলাম । তাঁকে মিনিট কয়েক আগে নেয়া হয়েছে মেডিক্যাল । অয়ন দা এখন সুস্থ । কিন্তু, ক্ষণে ক্ষণে ব্যাথা তাঁকে আজও মনে করিয়ে দেয় । জামাত শিবিরের বর্বরতা ।

যে ফুলগুলো ঝরে গেছে অবেলায়

১৯৮৮ সাল। চট্টগ্রাম কলেজ এর সম্মান এর ছাত্র মাহমুদুল হাসান । চট্টগ্রাম জেলা দাবা চ্যম্পিয়ন। ডবলমুরিং থানা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক । নগর ছাত্র ইউনিয়নের ক্রীড়া সম্পাদক তখন। বরাবর এর মত সেদিনও কলেজে গেছেন । শিবিরের কর্মীরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় প্যারেড মাঠের কোণায় । প্লাস দিয়ে তুলে ফেলে আস্ত কাঁচা দাঁত। বেধড়ক পিটিয়ে জখম করা হয়। একসময় চেষ্টা করে হাত কাটার। তাঁর কান্না আর মাতমে আশপাশে জমে যায় সাধারণ মানুষ । কোনক্রমে ভাগ্যচক্রে বাঁচে মাহমুদুল হাসান । বন্ধ হয়ে যায় তার শিক্ষা জীবন । চট্টগ্রাম কলেজ এর পাট চুকিয়ে দিয়ে বেসরকারী কলেজ থেকে কোনভাবে ডিগ্রি পাশ করেন । শারীরিক ও মানসিক চাপে পর্যুদস্ত মাহমুদুল হাসান ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি দেয় ইউরোপে । বহু বছর কাটিয়ে ও ইউরোপে থিতু হতে পারেনি হাসান ভাই। দেশে ফিরে এসেছেন অনেক বছর হল।

Anis Sazzad চৌধুরী । ইংরেজিতে সম্মান এর ছাত্র ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজে। ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন তিনি । পত্রিকায় ছাপা হল প্রেস বিজ্ঞপ্তি । শিবিরের চোখ পড়ল। ভদ্র ভাষায় কঠিন চাপ। কলেজে আসা যাবেনা। থেমে গেল আনিস ভাই এর স্বাভাবিক শিক্ষা জীবন । জীবন এর চাহিদায় তিনি পরে পাড়ি দিলেন আবু ধাবী। দুই দশকের অধিক সময় কাটিয়ে তিনিও এখন স্বদেশে ।

ইফতেখার কামাল খান । চট্টগ্রাম কলেজ এ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছেন । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে । রাষ্ট্র বিজ্ঞান এর ছাত্র ছিলেন । শিবিরের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে, ছাড়তে হয়েছিল চট্টগ্রাম কলেজ এর শিক্ষা জীবন । অকালে ছাত্র জীবনের পাট চুকিয়ে ঢুকতে হল চাকুরিতে।

দশক জুড়ে অব্যাহত শিবিরের নৃশংসতা

আশির দশক জুড়ে নিত্য ঘটনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিবিরে অব্যাহত নির্যাতন । শাহাদাত তো জীবন দিলেন। আর অন্যরা বেঁচে থাকলেও মূল্য দিলেন শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, আর শিক্ষা জীবন বিসর্জন দিয়ে । শত রকমের নিপীড়নের স্মৃতি চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ , কমার্স কলেজ আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের । একজন একরাম হোসেন ভাই কতবার নির্যাতন এর শিকার হয়েছেন, সে কেবল তিনিই হয়ত মনে রেখেছেন। দগদগে ঘা হয়ে এইসব স্মৃতি পোড়ায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আমজাদ হোসেন ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হল। চট্টগ্রাম কলেজে চঞ্চল সরকার এর মাথা ফাটানো হল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসুম ভাই এর পা ভেঙে দেয়া হল।চবি’র বাদল ভাইয়ের পা ভেঙে ফেলা হল। নাজিম মুরাদ কে নিষ্ঠুর ভাবে পেটানো হল । Rafiqul Bahar এর উপর আক্রমণ হল মহসিন কলেজে । সহপাঠী শিবিরের কর্মী ডেকে নিয়ে গেল কথা আছে বলে। তারপর মারধর । কোন ক্রমে জীবন রক্ষা । Sharafuddin Kabir Anis এর মার্কশিট সহ মুল ডকুমেন্ট কেড়ে নেওয়া হল কমার্স কলেজে। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় একুশে সংকলনের বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে থাকা অবস্থায় তখন নগর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আলেক্স আলীম ভাই এর উপরে শিবিরের নিষ্ঠুর হামলা। সাথে ছিলেন Hasan Imam Chowdhury আর কামরুল হাসান মেনন Kamrul Hasan Menon। কোনক্রমে রেহাই পান বাকী দুজন । অকাল প্রয়াত শাহেদ আজাদ আমিন , যিনি ছাত্র ইউনিয়নের চিকা বিকৃত করার জন্য শিবিরের কাছে প্রতিবাদ করতে ছুটে গিয়েছিলেন কমার্স কলেজ হোস্টেলে। কী ভীষণ সাহস ! মূল্য দিতে হয়েছিল শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়ে। এ ধরনের আরো অসংখ্য অব্যাহত হামলা, নির্যাতন এর শিকার হয়েও দুর্দান্ত সাহসের সাথে এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে আরো অনেক কর্মীরা কাজ করে গেছেন ।

“খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে”

উত্তাল আন্দোলনের তোড়ে ভেসে গেছে স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন। হামলা – মামলা – নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা। নেতা- কর্মীদের শিক্ষাজীবন স্বাভাবিক থাকেনি। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন থাকেনি। হাতের ঘড়ি বেঁচে মাইকের ভাড়া দিয়েছেন কেউ। মৃত্যুর শংকা নিয়ে প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন অনেকে। তবুও লড়াইয়ের মাঠ ছেড়ে যায়নি অনেকে। কিন্তু কী হল নব্বই উত্তর । ঝড়টা শুরু হয়েছিল আরো আগেই । সম্ভবতঃ ১৯৮৫ সালের দিকে গর্বাচেভ ঘোষণা দিলেন “গ্লাসনস্ত” আর “পেরেস্ত্রোইকা”। রুদ্ধদ্বারে হাওয়া । মতিউর রহমান একতা’র পাতায় লিখলেন । খোলা মন , খোলা হাওয়া বইছে । বার্লিন দেয়াল ভেঙে ফেলে দিল জার্মানবাসী। একে একে পূর্ব ইউরোপে গণেশ উল্টে যেতে লাগল । চসেস্কু নিহত । সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। গঠিত হল CIS ( কমনওয়েলথ অব ইনডিপেন্ডেন্ট স্টেটস্)। ১৯৯১ এর নির্বাচন এল। এক দল এর তিন প্রতীকে প্রার্থী । নৌকা- কাস্তে- তারা। একতা’র পাতায় ধারাবাহিক কলামে বিভক্ত মত। নবায়িত সমাজতন্ত্র । নতুন করে ভাবার গল্প এলো। ড. ম. আক্তারুজ্জামান লিখলেন সর্বহারার একনায়কত্ব হল পিরামিড এর মত । কার্যতঃ একনায়কত্ব । সিপিবির পঞ্চম কংগ্রেসে বিভক্তি চিহ্ন স্পষ্ট । দুই দলিল নিয়ে সিপিবি’র বিশেষ কংগ্রেস ডাকা হল। জেলায় জেলায় সাধারণ সভা। দুই পক্ষের নেতারা বক্তৃতা দিলেন। বিভক্তি পল্টন ছাড়িয়ে সারা দেশে। হঠাৎ দেখা গেল। পল্টনে দেয়াল। কারো মাথা ফাটল না। কারো রক্ত ঝরল না। এক সিপিবি হয়ে গেছে দুটি । আর প্রীতম হোটেলে এক তরুণ ঝুলে গেলেন ফ্যানের সাথে। রক্ত ক্ষরণ হল সিপিবি’র হাজার হাজার সদস্য- কর্মী- সমর্থকের হৃদয়ে। ক্রমশঃ ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা পরিষদ, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়নে ভাঙন এর সুর । পরিবর্তনবাদীরা ক্রমশঃ ভিড়ে গেলেন বিভিন্ন দলে। পরিবর্তনপপ্থীদের একটি বড় অংশ গেল গণফোরামে। বিপ্লবীরা রয়ে গেলেন মুল স্রোতের পরিচয়ে। অবিভক্ত সিপিবি’র পুরনো কর্মীদের বড় অংশ আসলে কোথাও গেলেন না। নীরবে সরে গেলেন । মনোজাগতিক প্রশ্ন ? এতদিনের বিশ্বাস, যাকে আস্থা মনে করা হত, টলে গেল সেটাই। পুরনো কর্মীদের চোট লাগল আস্থার । চিড় ধরল মনোবলে। অভ্যাস – অভ্যস্ততায় রইলেন যাঁরা তাঁরা ও আর জীবন মরণ পণ করে সঁপে দিতে রাজী নন। ছাত্র ইউনিয়নের অন্তঃসলিলা স্রোতে তখন ভাটার টান । ক্রমশঃ নতুন রিক্রুটমেন্ট কমতে লাগল। পুরনো পরীক্ষিত কর্মীদের মাঝে জীবনের হাতছানি । নতুন এর মাঝে যাবার আগ্রহ উবে যায়নি। তবে জোশ আর এলোনা। অনিশ্চয়তা – শংকা – ভয় যাদের গ্রাস করতে পারেনি, আদর্শিক অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নিল তাদের । স্পষ্টতঃ আদর্শের পরাজয় কঠিন কঠোর বাস্তবতা হয়ে দেখা দিল। পল্টনের দেয়াল হৃদয়ে দেয়াল তুলল। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রায় দেড় দশক ধরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সব চেষ্টা করুণভাবে ব্যর্থতার মুখে । যে আদর্শিক অঙ্গীকার প্রায় বিশ্বাস এর রুপে কর্মীরা গ্রহণ করেছিল তা রক্ষায় কোন চেষ্টা আর সাফল্যের মুখ দেখল না। নিছক সাংগঠনিক চেষ্টা, যোগাযোগ আর পুরনো কথার চর্বিত চর্বণ কাউকে বা কিছু কর্মীদের আকৃষ্ট করলেও বিপুল অংশ আস্থা রাখতে পারলেন না। ফলে মার্ক টাইম শেষ করে , মার্চ পাস্ট হয় না। ডাবল মার্চ তো দূর কী বাত !

“আলো নেই, রোদ নেই, কিছু বিপন্ন বিস্ময় “

সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সারা দুনিয়ার এক তৃতীয়াংশ ভূমিতে যে রাজনীতি ও আদর্শ উল্টে পাল্টে গেল , তার ব্যবচ্ছেদ কী দেখা যায়? সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন যা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই স্বপ্ন দেখা মানুষের মনেই বিনষ্ট হয়ে গেছে, তার নির্মোহ অনুসন্ধান কী চোখে পড়ে ? ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে নয়া দিগন্তরেখা কী দৃশ্যমান? যুক্তি বুদ্ধি যতটা না চোখে পড়ে , তার চেয়েও বেশি দেখা যায় বাক্ বিস্তার। পুঁজিবাদ এর অজস্র ব্যর্থতা , সংকট । ক্ষুধা- আসাম্য- যুদ্ধ- হিংসা- লোভ – বিচ্ছিন্নতা সত্বেও মানুষের বৈষয়িক জীবন এর অগ্রগতি পুঁজিবাদ কীভাবে সম্ভব করে তোলে ? সমাজতন্ত্র বৈষম্য বিলোপ করার দাবী সত্বেও , কী করে বিশেষ অধিকার ও সুযোগ প্রাপ্ত ক্ষমতাসীন নতুন গোষ্ঠী তৈরী করেছে? কেন ও কীভাবে সোভিয়েত ব্যবস্থা তার ভেতর থেকেই অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়েছে? নয়া সমাজতন্ত্র কীভাবে এই সকল প্রশ্নের মোকাবিলা করবে ? তার উত্তর সন্ধানী প্রয়াস কী দৃশ্যমান? সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী কোটি মানুষ আস্থা রেখেছিল সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বে ? কিন্তু, যে প্রকল্পটির শ্রেষ্ঠত্বে আস্থা রেখে সে জীবন দিতেও দ্বিধা করেনি , কার্যতঃ সে প্রকল্প যখন বাস্তবায়নের পরীক্ষায় ফেল করল , তখন কী আর সেটি প্রস্তাবিত প্রকল্পের অধিক হয়ে ওঠে ? তবুও মানুষের জীবন থেমে নেই । লড়াইয়ের মাঠেও আছে মানুষ। লড়াইয়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হয়েছে । পুঁজিবাদ অনেক ক্ষেত্রেই তার জনকল্যাণমূলক চরিত্র পাল্টে ফেলতে দ্বিধান্বিত নয়। ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা খাত। দুনিয়া জুড়ে বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের নামে, বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের নামে, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের নামে বেড়েছে ঘৃণার আবাদ। ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এর প্রাসঙ্গিকতা তীব্রতর । কর্পোরেট ট্যাক্স কমেছে । আর গরীব মানুষের জন্য দেয়া রাষ্ট্রের ভর্তুকি তুলে নেয়া হচ্ছে । ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ার ধারাবাহিকতায় স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা মানুষের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে । সুতরাং, আমাদের সংগ্রামের মূলগত কারণ গুলো আরো প্রাসঙ্গিক । সকল লড়াইকে একটি নিশানায় পরিচালিত করার যে বিশ্ববীক্ষা তা হয়ত আর আশা যোগায় না। বরং, লড়াইয়ের জন্য একটি সাধারণ বিশ্ববীক্ষা আদৌ কী প্রয়োজনীয়? সমগ্র দুনিয়ার সংগ্রামরত মানুষ কী তা ভেবেই লড়াইয়ে সমবেত হয়? লড়াই যখন অপরিহার্য ও ন্যায্য হয়ে ওঠে , তখন মানুষ সে লড়াই এর বৈধতা দেয়। প্রশ্ন হল , মানুষের বৈধ – ন্যায্য লড়াইগুলোর মধ্যে সম্ভাবনাময় ও বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়েই তো অগ্রসর হয় রাজনৈতিক দল। যে সততা, ন্যায় নিষ্ঠতা, মানুষের প্রতি অঙ্গীকার ও দরদ থেকে বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা যুক্ত হয়েছিলেন , অজস্র সংকট সত্বেও লড়াইয়ের পথে নেমেই , পথের দিশা বের করা ছাড়া অন্য পথ দেখিনা। সংগ্রাম এর অসংখ্য সম্ভাবনা আজ জীবন্ত । একসাথে পাটকলগুলি বন্ধ করে দেয়া হল । বিপুল সংখ্যক শ্রমিক হারাল কাজ। পাট চাষীর সামনে অন্ধকার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট। সর্বগ্রাসী লুটপাট- নৈরাজ্য । ক্ষীণতম প্রতিবাদ মোকাবিলায় প্রয়োগ করা হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি আইন। ব্যাংক- শেয়ার বাজার- আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ম এর বালাই নেই । ভোট দেয়ার অধিকার এর জন্য দশকের অধিক লড়াই । অর্জিত সেই অধিকার মানুষের হাতে নেই । সুতরাং, সমাজের নিপীড়িত- বঞ্চিত মানুষের লড়াইয়ের প্রয়োজন আরো প্রাসঙ্গিক । বামপন্থার যে দিশা , পরিবর্তনকে অপরিবর্তনীয় জেনে লড়াইয়ে নেমেছিল, তাকে সামনে দাঁড়াতে হবে মানুষের সাথেই। তত্ত্ব বুক পকেটে রাখা রেড বুকে নয়। তত্ত্ব কেবল শাদা কাগজের কালো হরফে নয়। তত্ত্ব নির্মিত হয় অভিজ্ঞতার কঠিন বাস্তবতা ও তথ্য – জ্ঞান- বিজ্ঞান এর অজস্র সংশ্লেষ এর মধ্যে । তত্ত্ব অচলায়তন নয়। অচলায়তন ভাঙতে তত্ত্ব ও সংগ্রাম কে চলতে হয় যুগপৎ । জানি, অন্ধকার চিরস্থায়ী নয় । কিন্তু, আলো খুঁজতে আশার আলো তো জ্বালাতে হবে। অজস্র নেতা- কর্মীদের রক্ত – আত্মদান- ত্যাগ নিশ্চয়ই আলো দিয়ে আলো জ্বালাবে। রবি কবির গানে শেষ করি –

“খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে।
থাক্‌ তবে সেই কেবল খেলা,
হোক-না এখন প্রাণের মেলা–
তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণায় গাহি রে॥”