তুরষ্কে তিন দিন ও গণতন্ত্র ভাবনা

এপ্রি ২৭, ২০২৩

কামাল আতাতুর্ক দাবী করেছিলেন , তাঁর দেশের বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে । সে ঐতিহ্য শুধুমাত্র অটোমান বাদশাহীর হাতে গড়ে ওঠেনি। অটোমানদের আগে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ছিল । তারো আগে ছিল রোমানরা । অটোমান সাম্রাজ্যের বাদশাহী তাদের জমানায় অসংখ্য চার্চকে পরিণত করেছিল মসজিদে । হাজিয়া সোফী ( HAGIA SOPHIA) তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। রোমান – বাইজেন্টাইন – অটোমান সকলেই এসেছে বাইরে থেকে। এই সকল সাম্রাজ্যের হাত ধরে ধেয়ে আসা রাজন্য, পদাতিক ও হূকূম পেয়াদাদের সাথে এ ভূমির ভূমিপূত্রদের সংযোগ – সমন্বয় – মিলনে নয়া এক জাতি গড়ে উঠেছে । সম্ভবতঃ সবচাইতে বেশী তা ঘটেছে অটোম্যান কালেই। নির্মাণ -বিলয়- প্রতিস্থাপন এর সহস্র বছর পরও ৯৫ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বীর পাশাপাশি এখানে রয়ে গেছে চার্চ এবং সিনাগগ । খ্রীষ্টীয় ও ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা । পৃথিবীর সকল সালতানাতের ইতিহাসের সাথে মিল রেখে হত্যা – ষড়যন্ত্র- চক্রান্ত- নির্মমতা ও সৃষ্টিশীলতা এখানে হাত ধরে চলেছে পরষ্পর । রোমান- বাইজেন্টাইন- অটোম্যান সাম্রাজ্য ঠিক চলেছে তেমন করে , যেমন করে সাম্রাজ্য চলে । বসফরাস ( আমাদের ভূগোলে লেখা ফসফরাস প্রণালী) যে সংযোগ তৈরী করেছে ভৌগোলিকভাবে , ব্ল্যাক সি ও ম্যারম্যারাস সি এর মধ্যে , যা কালে কালে ইউরোপ ও এশিয়ার জন্য তো বটেই বরং বলা ভালো বিশ্ববাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে , তাইই ভূ-মানচিত্রে তুরষ্কের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। সুতরাং , আরবের পাশে থেকেও সে কুলীন হয়ে উঠেছে আরবদের ছাড়িয়ে । ইউরোপের পাশে থেকে সে শতাব্দীর পর শতাব্দী শুধু ইউরোপের সমীহ উদ্রেক করেই ক্ষান্ত দেয়নি , সীমানা সম্প্রসারিত করেছে ইউরোপে । আরব দুনিয়া , আফ্রিকা’র একাংশকেও তার অঙ্গীভূত করার সাহস দেখিয়েছে । ইতিহাসও তেমনি নিরাভরণ ও নিষ্পৃহ ভঙ্গীতে ঠিক ঠিক দাগ কেটে গেছে তুরষ্কের সামাজিক জীবনে । এখানে আরব – অনারব , ইউরোপ – অইউরোপীয়, এশিয়া ও এশিয়া ছাপানো সংস্কৃতির এক অদ্ভুত ও অনন্যসাধারণ সম্মিলন পাওয়া যায় ।

এবার আসি চোখে দেখা কথায় । গতকাল সারাদিন ধরে আলাপ হওয়া মেয়েটি ছিল আমাদের ট্যুর গাইড । একেবারেই ভয়হীন চিত্তে সে বলে দিল , “আমি মুসলমান । আমাদের দেশের ৯৫ শতাংশের অধিক মুসলমান। তবে আমরা ট্রাডিশনাল আরব নই । আমরা ইউরোপীয় ও নই । আমাদের লোকেরা আরবীয় স্টাইলে অনেকে পরষ্পরকে উইশ করে । কিন্তু , আরবদের অধিক কিছু আমাদের আছে । আমাদের মধ্যে ইউরোপীয় ঘরাণারও বহু কিছু আছে । কিন্তু আমরা ইউরোপীয়ান নই ।” মেয়েটির পরণে ছিল জিনস্। মাথা হিজাব বিহীন । আমি তাঁর পোষাক ও তুরষ্কে আমার দেখা পুরুষ ও নারীদের আধুনিক ( প্রথাগত অর্থে) পোষাকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম , “এটা তো এরদোয়ান এর তুরষ্ক মনে হচ্ছে না। ” ততোধিক প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে মেয়েটি বলল ,” আমরা একটি সংকর জাতি । এখানে তথাকথিত আধুনিক ভাবধারার জীবন পাওয়া যাবে । একি সাথে পাওয়া যাবে ট্রাডিশনাল আরব কালচারাল জীবন । কিংবা এ দুই জীবনেরও সম্মিলন।”

গত তিন দিন ধরে , ইস্তাম্বুল ঘুরেছি । নেমেই সকালে গিয়েছিলাম তাকসিম স্কয়ার । ঠান্ডা কাটাতে গেলাম কফি শপে। তখন বেলা সকাল নয়টা। কফিশপ থেকে বেরিয়েই দেখলাম , পরণে জিনস – মাথায় স্কার্ফ পরিহিত একটি মেয়ে মূহূর্তে চুমু খেল সহযাত্রী তরুণকে । ইউরোপ আমেরিকায় যা একেবারেই নিষ্পাপ দৃশ্য । যেরুপ দৃশ্য আরো বার কয়েক দেখতে পেয়েছি। কি হল ? এরদোয়ান এর ইসলামিক রিভাইভেলিজম এর দেশে এ কোন্ দৃশ্য !! পথে দেখা পেলাম , যে ভঙ্গী ও পোষাকে হাঁটছে তরুণ – তরুণীরা তার সিংহভাগ ইউরোপীয় বা আমেরিকান স্টাইলের । আজ সকালে গ্রান্ড বাজারে প্রবেশের আগে পাশেই থাকা TC ISTANBUL UNIVERSITY’র গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ মুখে ইস্তাম্বুল জুড়ে দেখা দৃশ্যের পূনরাবৃত্তি মাত্র ।

কামাল আতাতুর্ক আদেশ জারী করে এমন কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করেছিলেন , যা ফারাক করে তাঁর পূর্বে বিদ্যমান সামাজিক আচরণ ও জীবনবোধের সাথে। তিনি ও তাঁর জেনারেলরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন , তাঁদের চিন্তামত তুরষ্ক গড়তে । কঠিনভাবে তিনি দাগ টেনেছিলেন, রাষ্ট্র ও ধর্মের । তিনি গত হওয়ার পর ১০০ বছরও পেরোয়নি । তিনি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অর্জন করতে চেয়েছিলেন, তুর্কী জাতীয়তাবাদের নয়া রুপকে আবাহন করেছিলেন , তিনি যা ভেবেছিলেন তাইই ভাবাতে চেয়েছিলেন তুর্কী জাতিকে । শত বছরো না পেরুতেই , সেই তুর্কী এবাউট টার্ণ করার চেষ্টা করছে এরদোয়ানের হাত ধরে । কামাল পাশা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার স্থলে এনেছিলেন আধুনিক শিক্ষার জোয়ার। এরদোয়ান চাইছেন , রাষ্ট্রের একটা ধর্মীয় চরিত্র । কামাল পাশা চেয়েছিলেন , সালতানাতের হাত ধরে তুর্কীদের শ্রমে ঘামে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে , তার স্থলে একটি আধুনিক তুর্কী। তাঁর সহায় ছিলেন তুর্কী সেনারা। তিনি জনগণকে মোবিলাইজ করেছিলেন। আজ এরদোয়ান চাইছেন পুরনো ভূমিতে নতুন করে পুরনো ইসলাম । কামাল পাশা গণতন্ত্র দিয়েছিলেন , রাশ ছিল তাঁর হাতে। এরদোয়ান ও চাইছেন তাঁর হাতে রাশ ধরে রাখা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। কার্যত এসব গণতন্ত্র নয়। অটোম্যান – বাইজেন্টাইন – রোমানরা ও গণতন্ত্র দেননি।

সুতরাং , গণতন্ত্রহীন সমাজে স্বৈরাচার শেষ কথা। জনগণের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যায় , স্ব ঘোষিত দেবদূতরা ( Saviour ) যা মনে করেন , তা বাস্তবায়ন করেন । এবং তাইই শেষ কথা।

একবার কি ভাবা দরকার নয় , মানুষ সেই স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যের আমলে যেমন দাস ছিলো , আজ বা গতকাল ও কি তাই ছিলোনা ?

যা দরকার তা হল , গণতন্ত্র । নিরংকুশ গণতন্ত্র । যখন মানুষ কথা বলবে। তার ভবিষ্যৎ নির্মাণের কারিগর হবে।

সে কি সোনার পাথরবাটি ?

অক্টোবর ১৪, ২০১৮