নয়া জমানার সন্ধানে

এপ্রি ২৭, ২০২৩

“যে পৃথিবী খুঁজছি আমি কোথাও মেলে না
নতুন মাটি নতুন আকাশ কোথাও মেলে না ।

নতুন মাটি নতুন আকাশ না-ই বা মিলুক
নতুন মানুষ ? তার নিশানাও কোথাও মেলে না ।”
———-কৈফি আজ্মি

সক্রিয় রাজনীতিতে থেকে , তুমুল ঘটনার বিবিধ স্রোতে ভেসে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের চিন্তাগুলো আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তা থেকে দূরত্বে অনেক কিছুই নির্মোহভাবে দেখা যায়। ঘটনার ভেতরে থেকে কার্যতঃ তা কঠিন । যদিও প্রকৃত ঘটনার অভ্যন্তরে থেকে , পরিবর্তন এর লড়াই তাতে এতটুকু গুরুত্ব হারায় না। ইসকন বিষয়ে একটা পোস্ট এবং একই সময়ে বিদ্যানন্দ সংশ্লিষ্ট একটি পোস্ট করার পর কিছু মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবছিলাম। প্রথমে ভাবলাম, মৌনতাই শ্রেয়। পরে ভাবলাম, ভাবনাগুলো নিয়ে ভাবা যাক।

এটা সত্য যে, সংখ্যালঘুর মনঃস্তত্বে তার জন্য নিরাপদ কিংবা তার দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষ, নিদেনপক্ষে সেরকম অবস্থান এরকম দলের দিকেই সে অবস্থান নেয় ।

পশ্চিমবঙ্গে এদেশ থেকে যাওয়া উদ্বাস্তু মানুষেরা একসময় বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। “পূর্ব পশ্চিম” উপন্যাসে উদ্বাস্তু নেতা হারিত মন্ডলরা দেখতে পায়, উদ্বাস্তু আন্দোলনের পাশে বামপন্থীদের। এ উদ্বাস্তুরা তো সকলেই ছিলেন প্রধানতঃ হিন্দু ।

আবার, যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের পছন্দের দল ছিল বামপন্থীরা। এখন সে জায়গা নিয়েছে, তৃণমূল । কারণ, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিজেপি’র হিন্দুৃত্ববাদী আক্রমণ এর বিরুদ্ধে এদেরকে সহায় মনে হয়েছে । এবং, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদী শক্তি আগে বামফ্রন্টকে অভিযুক্ত করত মুসলিম তোষণ (!) এর জন্য, এখন করে মমতার তৃণমূলকে।

বাংলাদেশে ভোটের মাঠে বামপন্থীরা পাকিস্তানি আমল থেকে এ অবধি কখনো উল্লেখযোগ্য শক্তি হয়ে ওঠেনি। ফলে, রাজনীতিতে বামপন্থীদের সাথে থেকেও, ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে হিন্দু সম্পদায়ের লোকজন আওয়ামী লীগকেই তার সমর্থন ভোটের রাজনীতিতে দিয়েছে।

এ হল দুনিয়া জুড়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আমেরিকায় নন হোয়াইট, মুসলিম, এশিয়ান, মেক্সিকান ইত্যাদি অর্থাৎ সংখ্যালঘু জাতি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষের পছন্দ ডেমোক্রাটরা। ইংল্যান্ডে লেবার । চিত্তাকর্ষক হল , বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কিংবা এশিয়া থেকে গিয়ে মাইগ্রান্ট আমেরিকান কিন্তু ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত অবিশ্বাসী বার্ণি স্যান্ডার্স এর পেছনে। বিপুল সংখ্যায় ।

কথাটা হল , এই সকল জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষেরা নিজেরা সাম্প্রদায়িক কিংবা অসাম্প্রদায়িক যাই হোন না কেন, তাদের যূথবদ্ধ কমিউনিটি সমর্থনের মুল স্রোত তুলনামূলক বিচারে অসাম্প্রদায়িক/ সেকুলার/ নন রেসিস্ট এরকম শক্তির সাথেই যায় । নিরাপত্তা , অস্তিত্ব, বিকাশ এর প্রশ্ন যখন যুক্ত হয়ে যায়, তখন অপরাপর বিবেচনা গৌণ হয়ে ওঠে।

ভারতবর্ষে শ্রেণী- জাত – সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বগুলো এত বেশি পরস্পরের সাথে অঙ্গীভূত হয়েছে যে, কোনটি জাতের লড়াই, কোনটি আন্তঃধর্মীয় লড়াই, কোনটি বিদ্বেষ, কোনটি শ্রেণীর লড়াই তা ঠাহর করা মুশকিল হয়ে ওঠে। উত্তর ভারতে নিম্ন বর্ণের মানুষের নেতা বেশ কজন যাদব, বামপন্থীরা নয়। অর্থাৎ, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নিপীড়নের মুখে নিম্ন বর্ণের মানুষের কাছে শ্রেণী নিপীড়নের বিষয় মূখ্য থাকেনি। ফলে , বামপন্থা সেখানে গৌণ। যাদব রা মূখ্য শক্তি । কংগ্রেস ও বিজেপি’র প্রধান বিরুদ্ধ শক্তি বামপন্থার শক্তি নয়।

খুব অল্প কিছুদিন আগে , Altaf Parvez এর একটি বই পড়লাম । যোগেন মন্ডলের উপর। যিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন । বর্ণ হিন্দুদের নিপীড়নের প্রতিবাদে তার অনুসারী নিম্ন বর্ণের অচ্ছুত মানুষেরা বর্ণ হিন্দুদের সাথে শরিক হননি । কিন্তু, মুশকিল হল , যোগেন মন্ডল নিজে পরে পালিয়েছিলেন ভারতে। এবং তার অনুসারীরা আর কখনো শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি । কারণ, ফাইনালি মুসলিম লীগ তাদেরও রেহাই দেয়নি। যোগেন মণ্ডল এর মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ এর একটা দীর্ঘ পত্র আছে। সময় হলে পড়ে দেখা যেতে পারে ।

ফলে , ফিরে যেতে হয় Faruk Wasif এর কথায় । বাঙালির মুসলিম- হিন্দুর মন এক জলাভূমি । মীমাংসা না হওয়া অবধি ফসফরাস এর মত এখানে ওখানে জ্বলে ওঠে।

সুতরাং, যে ব্যক্তি ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে হিন্দু, অস্তিত্ব ও বিকাশের প্রশ্নে তার কাছে অপরাপর বিবেচনা ছাড়িয়ে ধর্মীয় পরিচয় অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে । আমরা যখন দেখি একই ব্যক্তি যতটা সরব ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা নির্যাতন এর বিরুদ্ধে, সেই একই ব্যক্তি ততটা নীরব , নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে নিপীড়নের প্রশ্নে। সে ব্যক্তি যখন মতাদর্শের দিক থেকে বামপন্থী হন, তখন আমরা বিস্মিত হই । এবং নিঃসংশয়ে বলতে হয়, তা প্রকৃত বামপন্থা নয়। কিন্তু, যারা এমন করেন, ভাবতে হয়, তারাও আসলে এ জমিনের মানুষ। সার্ত্রের কবিতা থেকে ধার নিয়ে বলি ‘সময় এর নিপীড়িত ক্রীতদাস ‘।

ভারী আশ্চর্য হতে হয়, উগ্র বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িকতাবাদী গোষ্ঠীর হাতে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর গণ নিপীড়নের প্রেক্ষিতে, নাফ নদীর স্রোতে ভেসে নিপীড়িত লাখো মানুষ যখন এসে উঠেছে টেকনাফ এর উপকূলে, তখন বামপন্থার চিন্তা প্রভাবিত মানুষের একাংশ এই বিপুল উদ্বাস্তু মানুষের প্রতি সহমর্মী ও সহানুভূতির পরিবর্তে ট্রল করেছে। রোহিঙ্গাদের বিপুল জন্মহার, বহু বিবাহ, অশিক্ষা – কুশিক্ষা এবং ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ার হবার সম্ভাবনা নিয়ে বামপন্থায় আস্থাবান মানুষের মধ্যে কাউকে কাউকে শংকা প্রকাশে অধিকতর ভাবিত দেখা গেছে। এই চিন্তাজাত মানুষেরা একই সাথে যখন দেশের বুকে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে উচ্চকিত হন, তখন সেটা হয়ে ওঠে এক স্ববিরোধিতা ।

এ এক অদ্ভুত ডিলেমা।
জানার কথা নয়, এরকম কোন মূহূর্তে কী কৈফি আজমি এরকম একটি কবিতা জন্ম দিয়েছিলেন ?

একটি ছবি আছে , তানভীর মোকাম্মল এর । ডকুমেন্টারি । বাংলাদেশে আটকে পড়া “বিহারী” দের নিয়ে । আমাদের যে জাতি, জাতিগত নিপীড়নের তীব্র শিকার , সেই আমরাই কিন্তু এই হতভাগ্য ও নিজ ভূমি থেকে উদ্বাস্তু এই লক্ষ মানুষের প্রতি নির্বিকার । ভারত থেকে পালিয়ে শত শত মাইল দূরে আসা এই লক্ষ মানুষ ইতিহাসের কোন এক সন্বিক্ষণে আস্থা রেখেছিল বাংলাদেশ এর আসন্ন অভ্যূদয় এ নয়, পুরনো পাকিস্তানে। তাদের কেউ কেউ নিপীড়নের সাথে ও যুক্ত হয়েছিল। এবং নিজেরাও একই নিপীড়নের শিকার হয়েছে। কিন্তু, মোহাম্দপুরের জেনেভা ক্যাম্পে বা সৈয়দপুরে যেই সব আদম সন্তানের জন্ম নিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতা অর্জনেরও পরে , তারা সমস্ত রাষ্ট্রীয় পরিচয় ও সুবিধা হারিয়ে কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন ? একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা বিভিন্ন জাতিসত্তার ক্ষুদ্র সংখ্যক মানুষের এই বেদনার জীবন আসলে কেন ? কার জন্য? কী হেতু ? আমরা কী জানি , কী তাদের মানসজগত ? যে জগত গড়ে তোলায় তারা কারিগর নন , কেবলি ফুট সোলজার। রাজার হুকুমে আস্থা স্থাপন করে যারা মাঠে গোলার শিকার হয় অথবা শিকার করে।

কারো কোন উত্তর বা প্রতি উত্তর নয়, এই কথাগুলো । যদি বিবেচনা করেন , বিভাজন- ঘৃণা ও বিদ্বেষ এর যে দৃশ্য আমাদের ব্যথিত করে , সেই বেদনা খোঁজার চেষ্টা । বেদনাকে অতিক্রম করে শুভ বোধের মানুষের সামনে , মুক্তিকামী মানুষের কাছে , প্রকৃত বামপন্থার মানুষের কাছে পথ একটিই, তা হল দেশ ও দুনিয়ার সকল রকম ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই। এ লড়াই আরো সুনির্দিষ্টভাবে গণতন্ত্রের লড়াই । কারণ , প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুনির্দিষ্টভাবে সম্পত্তির উপর অধিকার, বিশ্বাস এর উপর অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার । এবং তা বিজয়ী হতে পারে সংশয় -অবিশ্বাস- এর পারষ্পরিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও লঘিষ্ট মানুষের যূথবদ্ধ লড়াই এর মধ্য দিয়েই । অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকা শাসক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ, ব্যাপক প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নৈতিক বৈধতাকে নিঃশেষিত করে। সুতরাং, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজটি হয়ে উঠেছে এই আত্ম বৈপরীত্য থেকে মুক্তির দিশা। আরো দূর লক্ষ্যের অভিমুখে যাঁরা যেতে চান, শ্রেণী বৈষম্যের অবসান যাঁরা চান , এই কর্তব্যের মীমাংসা করেই যেতে হবে তাঁদেরও।

মে ৯, ২০২০