“কিসে মাতাল হবে, সুরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা
তোমার পছন্দ। কিন্তু মাতাল হও।
এবং যদি কোনো সময়ে, কোনো প্রাসাদের সিঁড়িতে,
কোনো খানা-খন্দের সবুজ ঘাসের মধ্যে, অথবা
তোমার নিজেরই ঘরের নিরানন্দ নির্জনতায় তুমি
জেগে ওঠো, তোমার নেশা যখন কমতে শুরু করেছে
অথবা কেটেই গেছে, জিজ্ঞেস করো বাতাসকে, ঢেউ,
নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি এমন সব কিছুকে, যারা ওড়ে,
গুঞ্জন করে, গড়ায়, গান গায়, কথা বলে, তাদের
জিজ্ঞেস করো, এখন কিসের সময়,
তখন সেই বাতাস, ঢেউ, নক্ষত্র, পাখি, ঘড়ি তোমাকে উত্তর
দেবে :এখন মাতাল হবার সময়!
সময়ের নিপীড়িত ক্রীতদাস হবার বদলে মাতাল হও, একটুও না থেমে। সুরা, কবিতা অথবা উৎকর্ষ, যেটা তোমার পছন্দ ।”……শার্ল বোদলেয়ার।
মাতাল কে নয়? নাম, যশ, খ্যাতি, রুপ, স্তাবকতা, অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা, মদ। কোনটি নেশা নয়? যাতে কেউ বুঁদ হয়ে থাকে। নিষ্করুণ উদাসীনতায় মগজে গিজগিজ করা চিন্তা, যা নিজস্ব বলে একটা জগত দেয়। সেটা কী বানায় মানুষ? চিন্তার স্বাধীনতার কথা শুনি। বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা শুনি আমরা অহর্নিশি। ব্যক্তি যখনই তাঁর মত করে ব্যক্তিত্বের ভূবন গড়তে চায়। নিজস্বতার স্বাক্ষর রাখতে গিয়ে ক্রমশ আত্মমগ্ন হয়ে ওঠে অজান্তেই। অর্থ উপার্জনের মরিয়া মোহে ছোটে। যশপ্রার্থী কীসে যশ হবে তার প্রত্যাশায় তাতেই নিমজ্জিত হয়। মদে নিমগ্ন মানুষ যেমন আরো নিমজ্জিত হয় নিমজ্জিত করে নিজেকেই। সকাল বেলার সিংহ পুরুষ রাত্তিরে বিড়াল ছানা হয়। দিবস জুড়ে বাছুর ছানা দিনশেষে ব্যাঘ্র হয়ে ওঠে। সুললিত ছন্দে বাস করে যখন নিজস্ব জীবনের চারপাশের ছন্দ নাশ করে। তখন কীসের মোহে সে তাড়িত হয়? সুরাসক্ত মানুষের মোহ চেনা যায় সহজেই, কিন্তু সুললিত সুরের নীচে চাপা পড়ে যে জীবনের সুর, তাকেই বা কিভাবে দেখা যায়? বৈষয়িক জগতে মনুষ্যতর জীবনের বাসিন্দা যে, সুরাসক্ত হয়ে যখন সে পীড়ন করে স্বজনকেই, তখন সে মানুষ পদবাচ্য অর্জনের জন্য তার নিত্যকার হাহাকারও চাপা পড়ে। সেই মানুষের জীবনেও বেঁচে থাকার কী ভয়ংকর নেশা। তাকে কী করে দেখা যায়? পাশে শুয়ে থাকা বধু আার সন্তানের প্রিয় মুখ ছেড়ে যে মানুষের মরবার সাধ হয়, কোন নেশা তাকে তাড়িত করে? অথবা কীসের প্রলোভনে আার হাতছানিতে? এ কী এক গোলক ধাঁধা অথবা মনুষ্য জন্মের অভিশাপ!
আজ একটি নাটক দেখছিলাম। আন্তন চেখভ এর ছোট গল্প নিয়ে। ওয়ার্ড নং-৬। পাগলা গারদের নিপীড়ন, নিপীড়ক, নিপীড়িত, চিকিৎসক, প্রশাসক সকলেই পাগল হয়ে ওঠে ধারাবাহিকভাবে। তারাই ক্রমাগত আবিষ্কার করে চলে, জগতটাই ক্রমশ পাগলা গারদ হয়ে উঠেছে। পাগলা গারদের পাগলের প্রতি থাকে দয়া, করুণা, ঘৃণা, অবহেলা, পীড়ন। সহানুভূতি নয়, সংবেদন নয়। কারণ, এ জগতের সংবেদনে ডুবে থাকার সময় নেই । এ আত্ম মহিমা, আত্মপ্রসাদের জন্য নেশায় আচ্ছন্ন এক জগত।
এ জগতের সকল সম্পর্কের গোড়ায় রয়েছে আত্মপ্রাণতা। ইংরেজিতে কী একে ভাবানুবাদে
“নার্সিসিজম” বলা যায়? এখানে মাতালেরা পাগল হয়। পাগলেরা মাতাল হয়। কারণ, মাতাল আর পাগলের জীবনের গহীন সুতো আসলে একই তানে বাঁধা।
“প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই ” এর যে পৃথিবী সে আসলে যদেচ্ছা মাতাল ও পাগলের নার্সিসিস্ট জগত। খ্যাতি, বিত্ত, শক্তি, প্রশংসার সুরাসক্তি এ জগতের প্রাণভোমরা। মাতাল ও পাগলের এ জগত আমাদের ভ্রমের জগত। মানুষ যদি মানুষের সম্মান নিয়েই, মানুষ হয়েই থাকতে না পারল, তবে মানুষ আক্ষরিক সুরাসক্ত হলো কীনা, তাইই কী আর তাৎপর্য রাখে? যখন তার বসবাস আসলে মাতালের মত, পাগল হওয়াই যেখানে গন্তব্য। সে পৃথিবীর মানুষ কী নিয়ে তার মহত্ত্বের রুপকথা রচনা করবে?
জানে হয়ত ভবিষ্যতের মানুষ। বুড়ো সন্ত মার্কস তাইই ভেবেছিলেন। ভবিষ্যতের মানুষ আজ যে চিত্রকর, কাল তিনিই হয়ত প্রকৌশলী। সে জগতে কারো নার্সিসিস্ট হতে হয়না। তবে সে তো আজ কী বাত নয়। দুর কী বাত। তবুও, ভাবতে কী অসুবিধা?
২৭ নভেম্বর, ২০২২