পাঠ প্রতিক্রিয়া “প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান ” উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে অবিচল এক বোহেমিয়ান তরুণ

এপ্রি ২৭, ২০২৩

এক.
ষাটের দশকের শুরুতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এর হাত ধরে সিরাজুল আলম খান এর উত্থান ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। তখন আইয়ুব শাহীর শাসনকাল । এক টার্ম সাধারণ সম্পাদক থাকলেও ক্রমশঃ তিনি বলয় বিস্তারিত করেন দেশজুড়ে । নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে উঠে আসা তরুণ ক্রমশঃ নিজেকে মেলে ধরেছেন একটি গোটা দশকের প্রজন্মের মধ্যে । নেপথ্যের কুশীলব হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন বরাবর । তবে রাজনীতির ‘ট্রিকস’ বুঝতে সময় লাগেনি । সমসাময়িক কালে আরেকটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে মিলে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ১৯৬২ সালে। আইয়ুব এর লৌহযবনিকা অবসানে ছাত্র ইউনিয়নের মুল পদে না থেকেও মোহাম্মদ ফরহাদ যেভাবে ছাত্র আন্দোলনে ডিরেকশন দিয়ে গেছেন, সিরাজুল আলম খান সেভাবে ছাত্র লীগের নেতৃত্বে এক বড় অংশকে পরিচালিত করেছেন । ষাটের দশকেই বাঙালির স্বাধিকার বাসনা ক্রমশঃ ভাষা পেতে শুরু করে স্পষ্ট ভাবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন ছেষট্টি সালে। ক্রমাগত জেলে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলেন মুজিবুর রহমান । অব্যাহত কারা নির্যাতন এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পদাধিকারীর দায়িত্ব ধারাবাহিক ভাবে চালানো মুশকিল হয়ে ওঠে । এই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে মিলে ছাত্রদের এগারো দফা দাবি উত্থাপন করে ছাত্র লীগ সহ একত্রে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে। নেমে আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা । শেখ সাহেব সহ কতিপয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। একদিকে শেখ মুজিব সহ অপরাপর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এর দাবিতে আন্দোলন এবং একই সাথে ছয় দফা ও এগার দফার আন্দোলনে মধ্য দিয়ে সূচিত হয় ঊনসত্তর এর গণ অভ্যুত্থান । এই আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীকে , বিশেষ করে আদমজীর শ্রমিকদের যুক্ত করতে তিনি শরণাপন্ন হলেন ” নোয়াখাইল্যা শ্রমিক নেতা সাদু” র।

আহার – নিদ্রা- সংগ্রাম , যখন যেখানে যেমনভাবে জুটে, যে পরিস্থিতি তাঁকে যেখানে নিয়ে গেছে , তার মধ্যেই তিনি বাস করতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি । জীবন যাপন – বেশ ভুষা- খাওয়ার দাওয়া – রহস্যময় চলাফেরা তাঁকে বরাবরই আকর্ষণ এর কেন্দ্রস্থলে রেখেছে । না খেয়ে, বা মুড়ি খেয়ে , নিদ্রা হীন কাটিয়েছেন যেমন , তেমনি এক সাথে ছয় প্লেট বিরিয়ানিও খেতে পারতেন । রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানের “পার্সোনালিটি কাল্ট” নির্মাণ এর অবিরাম প্রয়াস তিনি চালিয়ে গেছেন । ষাটের দশকের শুরু থেকেই শেখ ফজলুল হক মনি’র সাথে নিরবচ্ছিন্ন আন্তঃ সাংগঠনিক লড়াইয়ে ছিলেন । শেখ পরিবারের সদস্য না হয়েও শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থা ও ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন। কারামুক্তির পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু ” উপাধি প্রদানের আইডিয়া তাঁর। তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদকে দিয়ে ছাত্র জনতার বিশাল সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু ” উপাধি প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাসে ” বঙ্গবন্ধু ” শব্দটিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের সাথে অবিচ্ছেদ্য করে জুড়ে দিয়েছেন । অজস্র সম্পর্ক, যোগাযোগ নিয়মিত মেইনটেইন করেছেন । কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের এক বড় অংশ কারাগারে আটক থাকায় ষাটের দশক জুড়ে, তৎকালীন ছাত্র লীগ ছিল আওয়ামী লীগের তো বটেই, আন্দোলন সংগ্রাম এর এক বড় স্ট্রাইকিং ফোর্স। ড্রাইভিং সিটের পেছনে তাঁর ভূমিকার কারণে ষাটের দশকের সংগ্রামী প্রজন্মের এক বড় অংশের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক আকর্ষণীয় তরুণ ব্যক্তিত্ব।

ষাটের দশকের শুরু থেকেই তিনি, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ মিলে একটি নিউক্লিয়াস পরিচালনার দাবী তাঁরা করেন। যেমনই থাকুক না কেন সে নিউক্লিয়াস, স্বাধীনতার দাবিকে দ্রুত সামনে আনা, স্বাধীনতার স্বপক্ষে তীব্র জাতীয়তাবাদী শ্লোগান তোলা , সমাজতন্ত্র সহ রেডিক্যাল কর্মসূচি আন্দোলনের সূচিভুক্ত করা, পতাকা তৈরী ইত্যাকার যাবতীয় অজস্র কাজের মধ্য দিয়ে একটি প্রজন্মের মধ্যে সে লক্ষ্যে সংগ্রামী স্পৃহা তৈরি করার লক্ষ্যে সচেতন প্রয়াস তিনি চালিয়ে গেছেন । বঙ্গবন্ধু আপামর বাঙালির নেতা হয়ে উঠেছিলেন, দেশজুড়ে তাঁর একদল নিবেদিত কর্মীদের অব্যাহত প্রচেষ্টার মাধ্যমে । সিরাজুল আলম খান সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের কর্মীদের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠেছিলেন ।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি মুজিব বাহিনী ( বিএলএফ) এর চার কমান্ডার এর একজন। যুদ্ধোত্তর কালে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এর পর, সেই বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান শেষে কণ্ঠের সব শক্তি জড়ো করে তিনি শ্লোগান দিলেন ” বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু “। সমবেত হাজার জনতা প্রত্যুত্তর তুলল ” জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ।” সিরাজুল আলম খান আবার শ্লোগান দিলেন ” মুজিববাদ মুজিববাদ”। জনতার প্রত্যুত্তর ” জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ “। ইতিহাসের কী নির্মম প্যারোডি জানুয়ারি ১৯৭২, পেরিয়ে ছ’মাস যেতে না যেতেই সিরাজ এর নেতৃত্বে ছাত্র লীগের এক বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর ছায়া ছেড়ে গেলেন , নয়া ছাত্র লীগে। অথবা পিতা মুজিব, ছাত্র লীগের সিরাজ সমর্থিত অংশের সম্মেলনে যোগ না দিয়ে গেলেন শেখ মণি সমর্থিত ছাত্র লীগের সম্মেলনে। যে বঙ্গবন্ধুর কাল্ট নির্মাণ এর কারিগর হিসেবে বিবেচিত হন সিরাজ, সেই সিরাজ এর নতুন দল জাসদ শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ বাদ দিল। সিরাজুল আলম খান মুক্তিযুদ্ধের সময় কালে নাম নিয়েছিলেন “সরোজ” । পরিচয় গোপন এর জন্য । কর্মীরা ডাকতেন “সরোজ দা”। দেশ স্বাধীন হলেও সে সূত্রেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন “দাদা ভাই “। দাদা ভাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে হয়ে উঠলেন “কাপালিক”। কেঊ কেঊ সে নামে তাকে ডাকেন। কেন জানিনা। তবে, এই গোটা ষাটের দশকের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধ অবধি তিনি নিষ্ঠার সাথেই ছিলেন।শ্মশানে তন্ত্র মন্ত্রের গুপ্ত সাধনাকারীদের কাপালিক বলা হয়ে থাকে। তিনি সে রকম সাধনা করতেন না। তবে, তার রাজনীতি অজস্র সম্ভাবনাময় তরুণকে রাজনীতির শ্মশানে বা সত্যিকার এর শ্মশানে ডেকে এনেছিল।
সে আলোচনা অন্য পর্বে।

লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রথমা থেকে প্রকাশিত। প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ লেখক এর অপরিসীম পরিশ্রম ও অনুসন্ধান এর ফসল। বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের অনুসন্ধানী পাঠককে এই গ্রন্থ তৃপ্ত করবে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া দুই ।
প্রতিনায়ক :সিরাজুল আলম খান

“হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত – ‘রক্ত খরচ’ তাতে”

রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতা এলো। চোখে মুখে নতুন স্বপ্ন। বেশিরভাগ মানুষের স্বপ্ন দেশটাকে গড়তে হবে। আর ক্ষুদ্র একদল মানুষের সামনে তখন যেন প্রবল ক্ষুধা । অপরিমেয় ভোগের হাতছানি । লুণ্ঠনের সর্বগ্রাসী জিহ্বা যেন লক লক করছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সনে বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র ফেরত দিলেন মুজিব বাহিনীর ( বিএলএফ) সদস্যরা । তারা অস্ত্র গ্রহণ করেছিলেন কাগজে স্বাক্ষর করে । কিন্তু, অস্ত্র ফেরত প্রদানের প্রাপ্তি স্বীকার করলেন না কেউ। ছয় হাজার সাতশো সদস্য বিএলএফ এর ট্রেনিং নিয়েছিলেন । এর বাইরেও ছাত্র লীগের হাজার হাজার সদস্য সহ অপরাপর সংগঠন ও ব্যক্তি ট্রেনিং নিয়েছেন মুক্তি বাহিনী ( এফ এফ ) এর মাধ্যমে । রয়ে গেল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র । যা ফেরত প্রদান করা হয়নি। ষাটের দশকে রাজনীতিতে মারামারিতে ব্যবহার করা হত লাঠি, হকি স্টিক, চাপাতি, ছুরি । নয়া দশকে এল আগ্নেয়াস্ত্র । তরুণদের হাতে রয়ে গেল মুক্তি যুদ্ধের অস্ত্র । পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে যুদ্ধ কালীন সময়ে লুট করে নেয়া অস্ত্র । এখন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ এর ভাষা আশ্রয় নিল সশস্ত্র লড়াইয়ে । মুক্তি বাহিনী বা মুজিব বাহিনী ছাড়াও দেশেরবুকে জন্ম নেওয়া নানান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে রয়ে গেল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র । সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হবার খোলা ময়দান হল রাজনীতির মাঠ। প্রতিহিংসা ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য জন্য , ব্যাক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য, ব্যাংক ডাকাতি বা লুটতরাজ এর জন্য, পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলের লড়াইয়ে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হতে শুরু করল। পুরোটাই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি । এরই মধ্যে রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠন এর উপর প্রধানতঃ ভর করে জাসদ রাজনীতি শুরু হল। প্রতিপক্ষ পুরনো রাজনৈতিক সহযোগিরা। হামলা এক তরফে হয়না। প্রতিপক্ষ ও একই ভাষায় জবাব দেয়া শুরু করেছে । রক্তের স্রোত বয়ে যায় ।

তেমন কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্মকৌশল এর হোমওয়ার্ক ছাড়াই যাত্রা শুরু করে জাসদ । শাসক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং শাসক দলের ছত্রছায়ায় চলতে থাকা লুটপাট এর বিরুদ্ধে জনমনে গড়ে ওঠা ক্ষোভকে ব্যবহার করে তীব্র সমালোচনা মুখর হয়ে ওঠে জাসদ। ছাত্র লীগের একটি বড় অংশকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় জাসদ। শ্রমিক লীগের একাংশকে নিজেদের সাথে পায় জাসদ। কিন্তু, মুল দল আওয়ামী লীগের প্রায় সমগ্রটাই অক্ষুণ্ণ থাকে। যদিও অপরাপর পুরনো রাজনৈতিক দল যেমন ন্যাপ ভাসানী ,ন্যাপ মোজাফফর এবং বামপন্থী কমিউনিস্টদের ছাড়িয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিরোধী দলে পরিণত হয় জাসদ। সিরাজুল আলম খান দলের অভ্যন্তরে যথারীতি অঘোষিত মুল নেতা হওয়া সত্বেও, আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বে অনুপস্থিতিত থাকেন। তাঁর নির্দেশ ও চিরকুটে দল চলতে থাকে । “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য ঘোষণা করা হলেও খোদ সিরাজুল আলম খান সহ দলের নেতৃত্বের মধ্যে এই সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। কণ্ঠে তীব্র ঝাঁঝালো শ্লোগান, দলের মুখপত্রের ভাষায় ততোধিক ঝাঁঝালো উত্তেজনা থাকলেও তার নির্যাস ছিল খুব সামান্যই। দলের তাত্ত্বিক হিসেবে ডেকে আনা হয় অর্থনীতিবিদ
ড. আখলাকুর রহমানকে। তিনি কৃষিতে ধনবাদের বিকাশ চিহ্নিত করে ঘোষণা করলেন বিপ্লবের স্তর হবে সমাজতান্ত্রিক । বিপ্লবের স্তরে যাই হোক না কেন, সিরাজুল আলম খান সহ জাসদের মুল নেতারা সকলেই ছিলেন একটিভিস্ট । একটি বামপন্থী দল পরিচালিত করতে যে তাত্ত্বিক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি দরকার, তার কিছুই তখনো গড়ে ওঠেনি। তাৎক্ষণিকতা ও কর্মসূচির ভিত্তিতে দল চলছিল । এর মধ্যেই সিরাজ পরিচিত হন শিবদাস ঘোষের দল এস ইউ সি আই এর সাথে মুবিনুল হায়দার চৌধুরী’র মাধ্যম । আত্মপ্রকাশের সাথে সাথেই জাসদ তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে । ফলে এই দিকগুলো অবহেলিত থেকেই যায় । অপ্রস্তুতির ঘাটতি মোকাবিলা আর হয়ে ওঠেনা।

নানান সংঘাত ও সংঘর্ষের পরেও জাসদ ছিল একটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল। কিন্তু, ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ইতিহাস সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যায় জাসদকে। কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ পল্টন এর বিশাল জনসভা শেষে হাজার হাজার মানুষ এর মিছিল ছোটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী’র বাসভবনের দিকে। সিরাজুল আলম খান নিজে স্বীকার ও করেননি, আবার দায়িত্বও নেননি এই সিদ্ধান্তের। কিন্তু, জাসদ নেতৃত্বের জবানিতে এটা এসেছে যে, সিরাজুল আলম খান এর চিরকুট ছিল মিছিলের অভিমুখ নির্ধারণ এর। মিছিল থেকেই প্রথম ফায়ার ওপেন কথা হয়। পুলিশের গুলিতে সরকারী ভাষ্যে তিনজন, জাসদ নেতাদের ভাষ্যে পঞ্চাশ জন নিহত হন। দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই গ্রেফতার হন। পরদিন থেকে বিভিন্ন স্থানে জাসদ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় । বাংলার বাণীতে প্রধান সংবাদ শিরোনাম হয়, ” জাসদ গুপ্ত সংগঠনের পরিণত হতে চলেছে “। ফলে সরকারী একশন ও সেভাবেই নেমে আসে। জাসদ এর পক্ষে কার্যতঃ অসম্ভব হয়ে ওঠে প্রকাশ্য রাজনীতি । প্রকাশ্য সংগ্রাম ও সংগঠনের পথ ছেড়ে জাসদ নেতৃত্ব গণবাহিনী গড়ে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে । সিরাজুল আলম খান বাঘের পিঠে সওয়ার হলেন। নিয়মতান্ত্রিক লড়াইয়ের অভ্যাস ও অভ্যস্ততা ছেড়ে গোপন রাজনীতি ও সংগঠনের পথে হাঁটা ততটা সহজ নয়। পাল্টাপাল্টি রক্তের স্রোত বয়ে যায় । গোপন হোক , প্রকাশ্য হোক বেঁচে থাকার জন্য নেতা কর্মীদের জীবন জীবিকা লাগে। বিপুল শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতা লাগে। প্রকাশ্য জীবনের অনুপস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্যই চাঁদা, সহযোগিতা পর্যাপ্ত না হলে ডাকাতি- লুটপাট এর পথেও হাঁটতে হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন সংগঠন এর এই দৃশ্য নতুন হয়। জাসদ নেতৃত্বের যে জায়গা থেকেই এই মন্ত্রীর বাসা অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি আসুক না কেন , সিরাজুল আলম খান এর দায় এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই । তিনি সে চেষ্টা করেননি । অব্যবহিত পরে বাকশাল ঘোষিত হল। বাকশাল ব্যতিরেকে অবশিষ্ট দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ হল। ফলে , গোপন রাজনীতি ও সংগঠনের পথ ছেড়ে অন্য পথে তথা গণ আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থান এর পথে হাঁটা আর হলনা ।

ইতোমধ্যে কর্ণেল তাহের যুক্ত হয়েছেন জাসদ এর সাথে । প্রকাশে নয় গোপনে। ১৫ আগস্টে ইতিহাস এর এক মর্মান্তিকভাবে বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে হত্যা করা হল। জাসদ এর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব কখনো সেই হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থান এর দায় নেননি। কিন্তু, ১৫ আগস্টের ঘটনার পরপরই বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাক এবং অভ্যুত্থান এর হোতাদের সাথে তাহের কথা বলেছেন । জাসদ নেতৃত্ব জেল থেকে বেরিয়ে ও আসলেন। কিন্তু, নেপথ্যের ঘটনা তখনো ঘটে চলেছে । জাসদ এর শীর্ষ নেতাদের কাছে তাহের প্রস্তাব রাখলেন, ৩রা নভেম্বর জেনারেল খালেদ এর নেতৃত্বে সংগঠিত অভ্যুত্থান এর বিরুদ্ধে জেনারেল জিয়াকে সমর্থন দানের। কর্ণেল তাহের এর সমর্থক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা লিফলেট বিতরণ করল ক্যান্টনমেন্টগুলোতে। ৭ নভেম্বর জেনারেল জিয়া মুক্ত হলেন । কিন্তু, তিনি অবসরপ্রাপ্তদের কর্ণেল তাহের এর সঙ্গে হাঁটতে রাজী হলেন না। ৭ নভেম্বর অভ্যূত্থানে ব্যর্থ হবার পরেও জাসদ নতুন অভ্যূত্থান এর ছক কষতে থাকে। জিয়া কঠিন আঘাত হানেন। তাহের সহ জাসদ নেতৃত্বকে জেলে পুরলেন। ১৭ মে ১৯৭৪ জাসদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রক্রিয়া বন্ধ হতে শুরু করলেও , তার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেনি । তাহের এর ফাঁসি হল । সিরাজুল আলম খান সহ নেতারা সব জেলে। নেপথ্য কোন সমঝোতার মাধ্যমে জাসদ নেতৃত্ব একে একে ১৯৭৮ এর পর বেরিয়ে আসতে থাকে। জেল থেকে বেরিয়ে সিরাজুল আলম খান আবার সক্রিয় হলেন। তখনো তার ছাত্র সংগঠন শক্তিশালী। ডাকসু সহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদে তখনো জাসদ ছাত্রলীগের শক্তিশালী অবস্থান । জিয়ার অধীনে জাসদ সংসদ নির্বাচন ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গেল। কিন্তু গোল বাঁধল তখন , যখন জাসদ আওয়ামী লীগ সহ বিভিন্ন দলের জোটে অংশ নেবে কীনা এই প্রশ্নে। তখনো জাসদ এর শ্লোগান ” রুখো বাকশাল, হঠাও জিয়া। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া “। দলের কর্মীদের পিঠে তখনো আওয়ামী লীগের লাঠির ঘা দগদগে । দলের তরুণ কর্মীদের প্রশ্ন উঠতে শুরু করল এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এর যৌক্তিকতা নিয়ে । ডাকসু নেতা মান্না- আখতার সহ জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির ৭ জন নেতাকে বহিষ্কার করে সিরাজুল আলম খান তাঁর নেতৃত্ব বজায় রাখতে চাইলেন। বাসদ এর জন্ম হল। জাসদ ছাত্রলীগে বিভক্তি এল। এর মধ্যেই জেনারেল এরশাদ এলেন। তার বিরুদ্ধে ১৯৮৩’র রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলন সূচিত হল। সিরাজুল আলম খান ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গিয়ে এই ছাত্র আন্দোলনের সংহিস ঘটনার জন্য ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাঁড় করালেন। সাধারণত বিবৃতিতে সিরাজুল আলম খান এর নাম থাকত না। কিন্তু, এই প্রশ্নে তিনি নিজে বিবৃতি দিলেন । নতুন প্রশ্ন ও অবিশ্বাস এলো। খোদ সভাপতি মেজর জলিল কে এর মধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে ।জলিল এর বিরুদ্ধে কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে লিবিয়া পাঠানোর অভিযোগ এলো। বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতিতে দলের অভ্যন্তরে নানান নোংরা দগদগে ঘা এর মত বাইরে বেরিয়ে এসেছে । রব – জিকু সিরাজ এর সাথে থালেন। শাহজাহান সিরাজ- ইনু বেরিয়ে গেলেন । দলের একচ্ছত্র নেতা সিরাজুল আলম খান ব্র্যাকেট অংশের নেতায় পরিণত হতে শুরু করলেন। এরপরেও দফায় দফায় জাসদ ভেঙেছে। জোড়াও লেগেছে। আবার ভেঙেছে। কিন্তু, জাসদের একাংশ অন্য অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ এর মধ্য দিয়ে দলের সাধারণ কর্মী- সমর্থকরা দল ছেড়ে দিলেন অনেকেই। কেউ এদিক ওদিক বিভিন্ন দলে গেলেন । এরশাদের আমলে রব সরকার সমর্থক বিরোধী দলের নেতা হয়ে হাস্যরসের পাত্র হলেন। ক্রমশঃ ওয়ান ম্যান পার্টি । গণবাহিনী কমান্ডার ইনু প্রবল প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সাথে জোট করলেন। মন্ত্রী হলেন। সকলে মিলে যে জাসদ ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এ নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল , সেই শব এর কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছেন। সিরাজুল আলম খান ক্রমশঃ সাথীবিহীন হতে হতে , এখন পুরনো ভক্তদের স্মৃতি ও অনুকম্পা নিয়ে বেঁচে আছেন , অমোঘ মৃত্যুর প্রতীক্ষায় । জাসদ এর শবযাত্রা বয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁর এককালীন অনুসারীদের কেউ কেউ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা ও অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় । সেই মুক্তি যুদ্ধের সবচেয়ে লড়াকু অংশের গর্বিত তারুণ্যের দলের নেতা সিরাজুল আলম খান ।ষাটের দশকে তাঁর অর্জন । তিনি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আস্থা ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের এক বড় অংশের তরুণেরা নেতা সিরাজুল আলম খান এর উপর ,স্বাধীনতা উত্তর কঠিন সময়ে আস্থা রেখেছিলেন । সিরাজুল আলম খান সংগঠক ছিলেন । নেতা নয় ততোধিক । আলোচনা- সমালোচনা- বিতর্ক ছাপিয়ে এটাই শেষ অবধি সত্য। তাঁর হাতে গড়ে ওঠা হাসানুল হক ইনু যেমন শ্লেষ মিশিয়ে বলেন, ” আইজি ছিলেন তিনি । এখন হয়েছেন ওসি ।” ইতিহাস তো তাঁকে দিতে চেয়েছিল । তিনি তাঁর যোগ্য ছিলেন কীনা ইতিহাস নির্ধারণ করে দিয়েছে ইতোমধ্যে ।

আগুনে ঝাঁপ দেয় কোন কোন পতঙ্গ । আগুনের লেলিহান শিখা ডাকে তাদের । প্রজ্জ্বলিত আগুনে ঝাঁপ দেয়ার সাহস ও শৌর্য্য জাসদ এর অজস্র নেতা কর্মীদের ছিল। যাঁদের এক বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে একটি প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে দাঁড়াতে সেই সুযোগ অপব্যয়িত হয়েছে । তবে সবকিছুই কী অযথা ? নিশ্চয়ই নয়। আগুনে ঝলসে গিয়ে ও কেউ কেউ যে সেদিন এর অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিল, তাও নিশ্চয়ই ভুলে যাবার নয়। সিরাজুল আলম খান আগুনের সলতেটা উস্কে দিয়েছিলেন, মেনে ও মানিয়ে নেওয়ার প্রচলিত স্রোতে ঢুকে যাবার সবটুকু সুযোগ হেলায় অগ্রাহ্য করেছেন ।

তিনি কী ইতিহাসের নয়া চ্যালেঞ্জ নিতে উত্তাল স্রোতে হাল ধরেছিলেন, না কী ভিন্ন কিছু ? সে উত্তর হল না জানা। অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। কিন্তু, এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি ” প্রতিনায়ক” গ্রন্থে । সিরাজুল আলম খান পরিণত বয়সে পৌঁছে গেছেন। তিনি খুব বেশি লোক সমক্ষে আসেন না বহুবছর । মরণোত্তর ও চাননা বহু মানুষ এর কাছে যেতে। মায়ের কবরের পাশে মায়ের শাড়ি গায়ে মুড়িয়ে , মায়ের গন্ধ নিয়ে শেষ শয্যা পেতে চান। বহু তরুণের স্বপ্নের নায়ক কী অবশেষে স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান ?