২৬ অক্টোবর, ২০১৯ বিডিনিউজ২৪.কম এ প্রকাশিত
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সমস্যা, কাঁটাতারের বেড়া, সীমান্তে গুলি করে হত্যা, হিমালয় থেকে যাত্রা শুরু করে যে নদীগুলো ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাতে উজানের দেশ ভারত কর্তৃক একে একে বাঁধ নির্মাণ, পানি প্রত্যাহার, অসম বাণিজ্য, উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে অবশিষ্ট ভারতের সংযোগের জন্য বাংলাদেশের নদী ও ভূমি ব্যবহার এর বিনিময়ে বাংলাদেশকে বঞ্চনার অভিযোগ, সাম্প্রতিককালে ভারতের সাথে যৌথভাবে কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতি ও পরিবেশ এর জন্য হুমকির সম্ভাবনা, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ভারতীয় রাডার স্থাপনের পরিকল্পনা এবং এই সকল ইস্যুতে বিশেষত পানি বন্টনে বাংলাদেশের দাবি ক্রমাগত উপেক্ষা ও দীর্ঘসূত্রিতা ভারত সরকারের ইচ্ছা-আন্তরিকতার অভাব ও ক্ষেত্রবিশেষে খবরদারি হিসেবেই বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে দৃশ্যমান। অতিসম্প্রতি, বাংলাদেশের সাথে ভারত এর সম্পাদিত চুক্তিগুলো সাধারণভাবে এদেশের মানুষের কাছে সমালোচিত হয়েছে ব্যাপকভাবে।
এটা নতুন কিছু নয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং বলা বাহুল্য সমাজ জীবনে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি ও আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, রাজনীতির মাঠ গরম করার উপাদান হিসেবে এই রাজনীতি যতটা উচ্চকিত, ঠিক ততটাই এ যাবত দৃশ্যমান বাংলাদেশ-ভারত সংলাপে বাংলাদেশের শাসক দলগুলোর সকল অংশের তরফে ততটা উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি। তীব্র ভারত বিরোধিতার রাজনীতি নিয়ে মাতামাতিতে বিএনপি এবং অনেক সময় জাতীয় পার্টির শাসনকালেও অগ্রগতি খুব দৃশ্যমান নয়। বরং, ভারত বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভারতপ্রীতি ও অনেক সময় আনুগত্যের অভিযোগ এনেছেন, এ যাবত সম্পাদিত পানিবন্টন চুক্তি সেই আওয়ামী লীগের বিগত জমানায় সম্পন্ন হয়েছে। তথাপি, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত নিয়ে বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে দৃশ্যমান চিত্রটি হতাশাব্যঞ্জকভাবে নেতিবাচক।
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের জনমানসে এই নেতিবাচক ধারণার বাস্তবতা কী? কেবল নিছক ভারত বিরোধিতার তানে বাঁধা সুরই কি তা তৈরি করেছে? নাকি, এর বাস্তব উপাদান রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য রচনায় ভারতের স্বীকৃত সহযোগিতা সত্ত্বেও, কেবল রাজনৈতিক ফাঁপাবুলির মধ্যেই কী তা গড়ে উঠেছে? অভিজ্ঞতা বলছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জমির ক্রমাগত মরুকরণের বাস্তবতাও সেচের পানির সংকটের সাথে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক পানি বন্টন আইন অনুযায়ী উজানের দেশ কর্তৃক পানি প্রত্যাহারের বিধি বিধান লংঘনের অভিযোগের বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। সীমান্ত বিরোধে একপক্ষীয় ও অনেকক্ষেত্রেই নৃশংসভাবে মানুষ হত্যার অভিযোগ সকলেই জ্ঞাত। দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ভিত্তিতে, পারষ্পরিক সম্মান রক্ষা করতে ভারতের তরফে ব্যর্থতা এদেশের মানুষের জন্য পীড়া ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে ঝুলিতে রয়েছে।
এই বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বিনিময়ে ১৯৭২-৭৫ কালপর্বে, এমনকি ১৯৯৬-২০০১ কালপর্বেও যতটুকু সাফল্য আওয়ামী লীগ সরকার দাবি করতে পারে, চলতি দশকে তা অনেকখানি নিষ্প্রভ শুধু নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে একতরফাভাবে তা ঝুঁকে আছে ভারতের দিকে। একটি দৃশ্যমান বিষয় বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে ও ক্ষমতা কেন্দ্রে বিজেপি’র উত্থান একটি সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রচনা করেছে। একই সাথে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে একতরফা ও বিশ্বাস অযোগ্য নির্বাচন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এর গণভিত্তি এবং সমর্থনের দুর্বলতাকে প্রকাশ্য করেছে। একটি গণরায়প্রাপ্ত সরকারের সাথে বিশ্বাসযোগ্যতাহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকা শাসকদলের পার্থক্য খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আমলা-প্রশাসন-পুলিশের জবরদস্তি নিয়ন্ত্রিত সরকারের দরকষাকষির ক্ষমতা হ্রাস পায় বলেই মনে করা হয়। এবং, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষত বৃহৎ ও ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আশীর্বাদ অর্জন যখন প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়, তখন দেশীয় স্বার্থ প্রধান এজেন্ডার অবস্থান হারায়। গড়পরতা মানুষের তা বুঝতে খুব বেশি কষ্ট হবার কথা নয়।
কেবল রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের পারষ্পরিক লেনদেন ও বোঝাপড়ার মধ্যেই ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের সমগ্র বিষয় আবর্তিত নয়। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসা পরস্পরা, ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতির ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি, ইন্দো-পাক বিদ্বেষ ও সংঘাতের রাজনীতি, যুদ্ধ এবং তার সাথে ধর্মীয় বিভাজন ও তজ্জনিত পরিচয়ের রাজনীতি বিষয়টিকে জটিলতর করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতির অনুসারী দলগুলো পাকিস্তানি আমল থেকে এ অবধি যতটা ভারত বিরোধিতার রাজনীতির আড়ালে ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি ও বিদ্বেষের রাজনীতি করেছে, বাস্তবে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থ ততটা প্রধান হয়ে ওঠেনি তাদের কাছে। ভারতীয় জুজুর আড়ালে পাকিস্তানি শাসকেরা জনগণের দৃষ্টিকে যতটা সম্ভব নিজেদেরকে আড়াল করতে সচেষ্ট হয়েছেন। কিন্তু, একটি গণতান্ত্রিক ও সমতার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। শান্তি ও উন্নয়নের যে যুগপৎ সম্পর্ক তা থেকে দূরে সরে গিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকেরা নির্বিচারে নিজেদের হতদরিদ্র জনগণের সম্পদের বিপুল অংশ বিনিয়োগ করেছেন সামরিক খাতে। ভারত ও পাকিস্তান এর এই চিরচেনা বৈরিতার রাজনীতিকে দু’দেশের স্বার্থান্বেষী চক্র ব্যবহার করেছেন নিজেদের দেশে অপরের বিরোধিতার মনস্তত্ত্বে। পাকিস্তানি জমানায় সূচিত ভারত বিরোধিতার রাজনীতি কার্যতঃ হিন্দু ও সেক্যুলার বিদ্বেষী রাজনীতিকে সবল করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের বৈশ্বিক রাজনীতিতে পাকিস্তান আশ্রয়পুষ্ট হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং ভারত যথারীতি তৎপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের। ফলে, সেক্যুলার ও প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে রাজনীতিতে এই দুই অক্ষ শক্তির বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর কাজটি হয়েছে কঠিনতর। নিশ্চয়ই, আমরা দেখেছি রেড মাওলানা খ্যাত ভাসানী ফারাক্কা ব্যারেজ ইস্যুতে সরব হয়েছিলেন, যা সঙ্গত কারণেই দেশপ্রেমিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু, সমস্ত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তিকে তা পুষ্ট করেছে। মাওলানা ভাসানীর আন্দোলনের ঝোল নিজের পাতে টেনে, তার ভিত্তিতে নিজেদের রাজনীতিকে পোক্ত করা, ভারত বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধিতা সমার্থক করে তোলা এই শক্তির কাছে নতুন নয়। খুবই ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা হল, বিশ্বজুড়ে দিল্লি-মস্কো বলয় এর বিপরীতে অতীতে চীন-মার্কিন আঁতাতের প্রেক্ষিতে, এদেশের বামপন্থী মহলে চীনাপন্থায় আস্থাশীলরা যেভাবে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি করেছেন বা দাঁড়িয়েছেন উচ্চকিত হয়ে, ঠিক একই সাথে অভিন্ন ইস্যুতে উগ্র ধর্মবাদীদের রাজনৈতিক অভিলাষ সম্পর্কে ততটা সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়নি। অপরদিকে, বামপন্থী বলে যারা মস্কোর উপর আস্থা রেখেছিলেন, তারা সর্বদা ভারত বিরোধিতার রাজনীতি যেন কোনোভাবেই বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত রাশিয়ার রাজনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয় তাতে সচেষ্ট ছিলেন। ভারত বিরোধিতার রাজনীতি যাতে দেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী বা মতলববাজীদের সুবিধা করে না দেয় সে বিষয়েও তারা কনসার্ন ছিলেন বলে মনে হয়। বহু দশক ধরে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রভাব ও তাতে নেহেরু অনুসৃত ধারণা যেমন: অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রভাব ধরে রাখা, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, সেক্যুলার ও প্রগতিশীল ধারা জারি রাখা শক্তিশালী ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা এবং তৎপরবর্তীতেও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ও ৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের সুযোগ ছিল ঐতিহ্যগত কংগ্রেসের সাথে লেনদেনের। এই সময়ে, বিশ্বজুড়ে দ্বিমেরু রাজনীতি অবসানের প্রেক্ষিতে, পুরনো বলয় ও অক্ষের বিপুল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, রেইস এর নামে ডানপন্থী রাজনীতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নিউ লিবারেল রাজনীতির বাড় বাড়ন্তের কালে লুণ্ঠনের-আগ্রাসনের-অসমতার রাজনীতি আজ পয়োমন্ত। এক একরকম নামাবলী চাপিয়ে পরিচয়ের রাজনীতি আজ সম্মিলন-সংশ্লেষ-আত্মীকরণ এর রাজনীতিকে কোনঠাসা করতে উদ্যত। ফলে, প্রকৃত দেশপ্রেমিক-সেক্যুলার-প্রগতিশীল রাজনীতির শক্তির জন্য কাজটি যুগপৎ চ্যালেঞ্জের ও ভারসাম্য অর্জনের।
ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতির ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান এর সৃষ্টি। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই তৎকালীন শাসক দল মুসলিম লীগের রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে ভারত বিরোধিতাকে পুঁজি করে। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের মধ্যে মুসলিম লীগ খুঁজে পেয়েছে ভারতীয় “ষড়যন্ত্রকারী”! সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর প্রায় সকল বাম প্রগতিশীল শক্তিকে “ভারতীয় দালাল” আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। যেকোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের” ষড়যন্ত্র আবিষ্কার ছিল মুসলিম লীগের নৈমিত্তিক বিষয়। তেভাগা আন্দোলন থেকে ছয় দফা আন্দোলন, ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী থেকে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী সব সংগ্রামকে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে চেয়েছে মুসলিম লীগ। আর অনুষঙ্গ হিসেবে প্রায় ক্ষেত্রেই এই আক্রমণের সাধারণ শিকার ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধও ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সংঘটিত হচ্ছিল মর্মে মুসলিম লীগ ও তাদের তৎকালীন অনুসারী ও সহযোগী এবং পাক সামরিক জান্তা তোপ দাগিয়েছে।
১৯৬২ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরপরই প্রণীত হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি আইন। পাকিস্তান এর শত্রু ভারত। কাজেই, ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশী (তৎকালীন পাকিস্তানি) হিন্দুর সম্পত্তি মানে তা শত্রু সম্পত্তি। এই ছিল চিন্তার দৃশ্যমান ঘোষণা। অপরদিকে ১৯৪৭ উত্তরকালে ভারতমুখী বাঙালী হিন্দুর স্রোত এবং তাদের থেকে যাওয়া স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তাদের অপরাপর আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে যেকোনোভাবে হস্তগত করার কায়েমী স্বার্থবাদী প্রচেষ্টা দারুণ ত্বরান্বিত হয়েছে শত্রু সম্পত্তি আইন এর ছাতায়। ১৯৪৭ উত্তরকাল থেকে পাকিস্তান এবং অধুনা বাংলাদেশ অবধি ভারত বিরোধিতার রাজনীতি ও হিন্দু বিদ্বেষী রাজনীতিকে সমার্থক করে তোলার চেষ্টা সবসময়ই ছিল। বস্তুগত, সামাজিক, মানসিকভাবে নিপীড়নের শিকার হিন্দু সংখ্যালঘুর বিপুল একটি অংশ তার আশ্রয়স্থল ভেবে ভারতে মাথা গুঁজতে চেয়েছে। যদিও, তার সেই প্রচেষ্টাও বিশাল বেদনাদায়ক ও কষ্টকর লড়াই এবং অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। বাপ-দাদার জন্ম ভিটেমাটি ছাড়ার এই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা সত্বেও ভারতমুখী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের স্রোত থেমে থাকেনি। আবার, এর পেছনে বেদনাদায়ক ও ক্ষেত্র বিশেষে নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা সত্বেও কেবলমাত্র সংখ্যালঘুর ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই তার উপরে ঢালাওভাবে ভারতীয় দালালের তকমা আরোপ করা হয়। ফলে, ভারত বিরোধিতার রাজনীতি কায়েমী স্বার্থান্ধ ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও শক্তির হাতে হয়ে ওঠে “ইউজফুল”। আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের থাকে “ভিক্টিম গেইম” এর শিকার হবার। এবং উভয় দেশেই এই রাজনীতি বিভিন্ন নামে ও প্রেক্ষিতে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রবন্ধের পরিসর বেড়ে যেতে পারে সে বিবেচনায় দীর্ঘ আলাপে না গিয়ে আমাদের নিকট ও দূরের অভিজ্ঞতা থেকে সংক্ষেপে একথা বলা যেতে পারে, কেবল “মুসলিম” পরিচয়ের কারণে সেলিব্রিটি তারকা থেকে, গভীর চিন্তক বুদ্ধিজীবী, জনমানসে নন্দিত রাজনীতিক কিংবা প্রতিবাদী সত্তার মানুষ ভারতীয় শাসকশ্রেণি ও দল কিংবা তাদের অনুসারীদের দ্বারা তথাকথিত “পাকিস্তানি দালালের” তকমা আরোপে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। ১৯৪৭ উত্তর প্রায় ৮ দশক অতিবাহিত হলেও, দু অংশেই এই ক্ষত বয়ে চলেছে।
দেশের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, এমনকি পরিবেশ ও প্রকৃতির স্বার্থে ভারতীয় শাসকশ্রেণি ও শাসকদলের আধিপত্যবাদী চিন্তা ও অবস্থান এর বিপরীতে দাঁড়ানো জরুরি। ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে, ভারতীয় শাসকশ্রেণি ও দল ভারতীয় আপামর জনসাধারণের আবেগ ও অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে কার্যতঃ নয়া উদারনীতির আড়ালে ভারতীয় বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে পরিচালিত। সুতরাং, যে ভারত চন্দ্রাভিযানের মাহাত্ম্য ও সাফল্যের আড়ালে লুকোতে চায় হাজার হাজার ভারতীয় চাষীর আত্মহত্যা। তার সাথে আমাদের মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে তিন হাজার কোটি টাকা অপব্যয় করা শাসকদের চরিত্রের ফারাক সামান্যই। ভারতীয় কংগ্রেস যেমন তার পূর্বতন চরিত্র হারিয়ে আদানী-রিলায়েন্স-টাটা-আম্বানি তোষণে বিজেপির চেয়ে পিছিয়ে নয়, তেমনি আমাদের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার চরিত্রের মধ্য বাম চরিত্র বহু আগে নির্বাসনে পাঠিয়ে বনেদী ব্যাংক লুটেরা আর নব্য লুটেরাদের স্বার্থে নিজেকে সঁপে দিয়ে ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে চায়। কাজেই, ভারতীয় শাসকশ্রেণি মানেই ভারতীয় জনগণ নয়। ভোটে নির্বাচিত হলেও নয়। এইটা বিস্মৃত হবার কোন সুযোগ নেই। বিস্ময়কর বিষয় হল, যে আওয়ামী লীগকে একদিকে হিন্দু তোষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, সেই আওয়ামী লীগের সময়কালে কিন্তু শত্রু সম্পত্তি আইন নয়ারুপে “অর্পিত শত্রু সম্পত্তি আইন” হিসেবে পুনরায় চালু হয়েছে। দেশের ঘোষিত সংবিধানে “ধর্মনিরপক্ষেতা” বহাল রেখেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারের ওআইসির সদস্য হবার উদগ্র বাসনায় বাধা হয়ে ওঠেনি। বিপরীতে, কংগ্রেসের ঘোষণা ও ভারতীয় সংবিধানের পাতায় যা-ই উল্লেখ থাকুক না কেন, কার্যতঃ কংগ্রেসের হাত ধরেই আধিপত্যবাদী ভারতের বীজ রোপিত হয়েছিল। বহু ভাষাভাষী জাতি ও ধর্মীয় সত্তার ভারত অন্তর্বস্তুর দিক থেকে ততটা উদার হয়ে ওঠেনি। যে কারণে, খোদ ভারতেই জাতিগত ও ধর্মীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষতের ও ক্ষোভের বহুবিধ প্রকাশ সংহিস ও অহিংস উভয় প্রকারে প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং, ভারত ও বাংলাদেশ দু তরফেই বিচ্ছিন্নতার, বিভেদের, হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি ও চিন্তা হালে পানি পেয়েছে দীর্ঘদিন ধরে শাসক দল ও শ্রেণির অনুসৃত নীতির মধ্যে।
রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের হিস্যা ও লেনদেন দুই দেশের শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থ ও ক্ষমতায় টিকে থাকার হীনস্বার্থে পরিচালিত হয় তখনই, যখন তা জনগণের ইচ্ছাধীন নয়। জনসমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ রাজনৈতিক দল, নৈতিক বৈধতাহীনতার কারণে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ভারতীয় আধিপত্যবাদী পুঁজির কাছে কতটা নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করতে পারে তা ইতিমধ্যে মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট। মুশকিল হল, ভারতীয় আধিপত্যবাদী পুঁজির কাছে এই সমর্পণ যুগপৎভাবে ভারত তোষণ ও হিন্দু তোষণের (“ভারতীয় দাদা” শব্দদ্বয় মনে রাখতে বলি) সমার্থক হয়ে ওঠে। যা কার্যতঃ ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতির শক্তিকে, বিভেদের শক্তিকে পুষ্ট করছে। বিপরীতক্রমে প্রসঙ্গত বলা যায়, সদ্য সমাপ্ত ভারতের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র রাজনীতির বাড় বাড়ন্ত অবস্থানের পেছনে অনেকেই মমতার তথাকথিত “মুসলিম তোষণ” নীতিকে দায়ী করছেন। কিন্তু, বাস্তবতা হল বিজেপি’র সাথে পাল্লা দিয়ে মমতাদেবী পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় দেবতা আমদানী করতে পিছিয়ে নেই। একইসঙ্গে, তাঁর দলের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি-লুটপাট-স্বজনপ্রীতি-সন্ত্রাস আড়াল করতে কখনো কখনো মাথায় হিজাব দিয়ে, মোনাজাতের ভঙ্গিতে ছবি তুলে মুসলমান ভোটের হিস্যা নিরংকুশ করতে চেয়েছেন। সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে তথাকথিত “মুসলিম তোষণ” এর কাল্পনিক অজুহাত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মীয় মেরুকরণকে তীব্র করেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ফাইনালি কংগ্রেস বা তৃণমূলকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকতে যেমন দেয়নি তেমনি আওয়ামী লীগকেও থাকতে দেবে এমনটা আশা করা বাতুলতা। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে, বাংলাদেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিক শক্তি, সমন্বয় ও সম্প্রীতির শক্তিকে দাঁড়াতে হবে। বিভেদের শক্তির চরিত্র প্রকৃতপক্ষে আপোসহীনতার আড়ালে আপোসকামী চরিত্র। জনগণের সমর্থন উপেক্ষা করে মানি-মাসল-কূটকৌশল নির্ভর শক্তির কাছে সমর্পণের নির্লজ্জ অবস্থান যখন আজ খুব স্পষ্ট, তখন প্রকৃত দেশপ্রেমিক শক্তি ও প্রগতিশীল শক্তি তারাই যারা এই বহু বছরের জীর্ণ-পরিত্যক্ত হবার অপেক্ষমান রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়াই শুধু নয়, দৃঢ়তার সাথে তাকে রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
ইতিহাসের বহু চড়াই উতরাইয়ের অবসান ঘটে গেছে। অক্ষ কেন্দ্রিক চিন্তার জমিন অপসৃত হয়েছে। পুরনো বিভেদ ও চিন্তার বিলয় ঘটিয়ে, নয়া বাস্তবতা উপলব্ধি ও লড়াই আজ জরুরি। ভারত বিরোধিতার রাজনীতির জমিনকে সাম্প্রদায়িক শক্তির স্বার্থে হাতিয়ার বানানোর রাজনীতিতে তুলে দেয়ার সুযোগ নেই। ভারতীয় আধিপত্যবাদী পুঁজি আর ভারতীয় নিপীড়িত জনগণ এক নয়। ভারত ও বাংলাদেশে লুণ্ঠনের শরিকেরা ধর্মীয় পরিচয় ছাপিয়েও লুণ্ঠনকারী। দুদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ও জনগণের লড়াইয়ের বর্শাফলক লুণ্ঠনের-আধিপত্যের এবং এর সিনিয়র ও জুনিয়র সহযোগিদের অভিমুখে পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। সংখ্যালঘুর অধিকার কেড়ে নেওয়ার হীন স্বার্থবাদী চক্রান্তকারীদের হাতে এই আধিপত্যবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের একচেটিয়া তুলে দিলে তা অনন্ত যুদ্ধের অনন্ত সংকটেই ডুবে থাকবে। বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও আধুনিক সমাজ নির্মাণের চিন্তার মধ্যে তাই যুগপৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চিন্তা তথা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়নবিরোধী সংগ্রাম তথা অসাম্প্রদায়িকতার সংগ্রাম এর সংশ্লেষণ জরুরি।