“মনেরে আজ কহ যে,ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে “

এপ্রি ২৪, ২০২৩

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২ টা পেরিয়েছে। ক্ষুধা তখন সপ্তমে। প্রায় ২৭০ মাইল এর ড্রাইভ শেষ হতে তখনও বাকী। যেতে হবে আরো ১০০ মাইল। ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট একটা ট্যুরিস্ট শহর Mammoth Village এ এক রাত কাটিয়ে আমরা ছুটছি সানফ্রান্সিসকো অভিমুখে। ভোর ৫ টায় ঘুম মাড়িয়ে ৭ টার টুরিস্ট বাস চেপে সারাদিন কেটেছে Yosemite National Park এ। বাস থেকে নেমেই ভোঁ দৌড়। ব্যাগেজ গাড়িতে তুলেই ছুট। ইতোমধ্যে রেস্তোরাঁ বন্ধ হতে চলেছে। দুখানা রেস্তোরাঁ খোলা পেলেও We are close বলে বিদায় করেছে। অবশেষে সানফ্রান্সিসকোর প্রবেশ মুখে পাওয়া গেল McDonald’s । কাঁধে ছিল সর্বক্ষণ এর সাথী ছোট্ট একটা ব্যাগ। পাসপোর্ট, সব ডলার, টিকিট। খেতে বসে মাস্ক খুলে রাখলাম। কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলাম সারা সময়ের সাথী ব্যাগ। যাওয়ার তাড়া। ডিনার শেষে গাড়িতে উঠবার আগে একখানা সিগারেটে কয়েক টান দেবার তাড়া। তাড়াতাড়ি সানফ্রান্সিসকো পৌঁছে বিশ্রামের তাড়া। এই সব তাড়ার চোটে কাঁধের ব্যাগখানি McDonald’s এ রেখে যে বেরিয়ে এসেছি তাইই মনে নেই। আবার যাত্রা হল শুরু। স্পিডোমিটারে তখন ৬৫ মাইল।
৫ /৭ মিনিট পরে মনে এলো ব্যাগ কই? এতক্ষণ সিট বেল্টটা মনে হচ্ছিল কাঁধের ব্যাগের স্ট্রীপ। ড্রাইভিং সিটে বসা প্রবল ধৈর্যশীল বন্ধুকে বললাম , ” ব্যাগ নেই। ফেলে এসেছি। ব্যাগে পাসপোর্ট, ডলার। ” আলো জ্বালিয়ে গাড়িতে খোঁজা হল। নেই। ৫/৭ মিনিট যদিও চলেছে গাড়ি জিপিএস ডিরেকশন এ। কিন্তু, ঠিক কোন পথে আমরা এসেছি ঠাহর করা যাচ্ছে না। আবার GPS search করা হল। Nearby MacDonald’s। ইন্টারনেটে কাছাকাছি লোকেশনে দেখা গেল বেশ কয়েকটি McDonald’s । কী করা যায়? কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা ! একটা McDonald’s এর কাছে গিয়ে বোঝা গেল, এটা সেটা নয়। মনে পড়ল McDonald’s এর সাথে লাগোয়া ছিল Starbucks । এবার Search করা হল Nearby Sturbucks। তার কাছে গিয়ে দেখা গেল তার পাশে McDonald’s নেই। এর মধ্যে উত্তেজনার পারদ বেড়েই চলেছে। রাস্তার পাশে একটা Gas Station এ স্থানীয় ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল Starbucks ও McDonald’s এর লাগোয়া জায়গার সন্ধান। পথিমধ্যে জল্পনা চলছে নিজেদের মধ্যে। রেস্তোরাঁর ওয়েটার পেলে কী আর স্বীকার করবে? ব্যাগ পেলেও কী ডলার ফেরত পাওয়া যাবে? টকা ৮৬ দিয়ে মনে মনে ডলার এমাউন্ট এর কনভার্শন এমাউন্টও হিসেব হয়ে গেল।

দু মিনিট গাড়ি চেপে পৌঁছা গেল কাঙ্ক্ষিত McDonald’s এ। বন্ধ হয়ে গেছে তখন McDonald’s। তখন ধোঁয়া মোছা চলছে। জানালায় টোকা দিতেই এক মধ্যবয়ষ্কা নারী ইশারা দিলেন মুল দরজায় আসতে। হাতে আমার ব্যাগটা নিয়েই দরজা খুলে দিলেন। নিজ হাতে আমার কাছে তুলে দিয়ে বললেন, ” আমি দেখেছি, তোমাদের টেবিলেই ব্যাগটা ছিল। তোমাদের পরে আর কোন কাস্টমার আসেনি। কাজেই, আমি নিশ্চিত এটা তোমাদের ব্যাগ।” তারপরও ব্যাগ খুলে ভদ্রমহিলাকে পাসপোর্ট দেখানো হল।” মহিলা বলে চললেন, ” প্রয়োজন নেই। আমি নিশ্চিত, এটা তোমাদের ব্যাগ।” ব্যাগ ফিরে পাওয়ার আনন্দে আর ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করাই হলনা তাঁর নাম। এমনকি তাঁর শার্টে লাগানো নেম প্লেটে ও নামটা দেখে নেয়া হয়নি। কোনক্রমে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর হাতে খানিকটা জোর করেই গুঁজে দেয়া হল ১০০ ডলার। মহিলা গেট ছাড়িয়ে আবারও এগিয়ে এসে বললেন, ” এর কোন দরকার নেই। এটা তো তোমাদেরই জিনিস। তোমরা টাকাটা ফেরত নিয়ে যাও।” যা হোক, আবারও অনুরোধ জানিয়ে ডলারটি গছিয়ে আমরা ছুটে চললাম। রাত তখন ১ টা পেরিয়ে গেছে।

মহিলার সাথে দেখা ক্ষণিকের । চেহারা ও কথায় বোঝা গিয়েছিল তিনি একজন মেক্সিকান। খুব ছোট্ট একটা চাকরি করেন। মার্কিন দেশে যা Odd Job বলা হয়। এতগুলো বছর ধরে যাদের ঠেকাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাহেব মেক্সিকোর সাথে সীমানা দেয়াল তুলতে চাইছেন। ছবির মত ঝকঝকে চকচকে রাখতে সমস্ত কাজের একটা বড় অংশ যারা করেন। বৈধ অথবা অবৈধ অভিবাসী নাগরিক এর জীবন বেছে নিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করেন। মেক্সিকোর শ্রমিক এর কম মজুরির শ্রম না নিয়ে আমেরিকার ঝকঝকে চকচকে বাড়ি এত সহজে এত সুলভ হত না। মেক্সিকোর কমলা, আপেল, সবজি ছাড়া আমেরিকার চলেনা। অথচ মনে হয়, গণতন্ত্রের স্বর্গভূমি দাবীদার এই দেশে মেক্সিকানদের প্রতি একধরণের জাতিবিদ্বেষ ও ঘৃণার কমতি নেই। মেক্সিকানরা এসে এই দেশে শ্রমের মজুরি কমিয়ে দিয়েছে। একই বিদ্বেষ খুঁজে পাওয়া যাবে অন্যান্য অভিবাসীদের প্রতিও। অথচ, স্বপ্নের আমেরিকা গড়ায় এদের অবদান বিপুল। শুধুমাত্র আমেরিকার রেলপথ নির্মাণে একক সংখ্যক সর্বোচ্চ অবদান চীনা শ্রমিকদের। যাদের দাস এর মত বিনা মজুরীতে কাজ করানো হয়েছে। এরকম অজস্র উদাহরণ যথেষ্ট, যাদের অপরিসীম শ্রমে আর ফসলে আমেরিকার সম্পদের ভান্ডার উপচে উঠেছে।

সেদিন রাতে আমরা নিজেরা এক একজন একটি হতদরিদ্র দেশের মধ্যবিত্ত নাগরিক হয়েও কী খুব সম্মানজনক আচরণ করতে পেরেছি মেক্সিকোর সে বৃদ্ধার প্রতি ? আমরা গড়পড়তা জীবনে শ্রমজীবী মানুষ সম্পর্কে সাধারণ যে ধারণা করি, তার উর্ধ্বে বা বাইরে কী যেতে পেরেছি? স্বীকার করে নিয়ে বলি, স্ব শ্রেণির চিন্তা – সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে ওঠা সত্যিই কঠিন। কয়টা ডলার হাতে গুঁজে দেয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সাধারণ ও তাত্ক্ষণিকভাবে ওয়েটার সম্পর্কে চিন্তার যে স্রোত তা কী আমাদের পাপ মোচন করবে? কেউ কী দ্বিমত পোষণ করবেন? এদেশে বলুন আর ভিন দেশে বলুন, কিংবা আমাদের দেশের কথাই বলুন বা ভেবে দেখুন। সমাজের সবচাইতে বড় আকারে অপরাধ সংঘটনে বা সহজ বাংলায় বৃহদাকার এর এক বৃহদাংশ বলুন, শিক্ষিত – বিত্তবান মানুষের আধিপত্য নিয়ে সংশয় থাকবার কোন কারণ কী আছে? কিন্তু, আমরা নিজেদের দেখিনা আয়নায়। মেপে চলি নিজেদের সৃষ্ট বাটখারায় অন্যদের।

অথচ, কত আগেই আমাদের রবি কবি বলে গেছেন, ” মানুষ এর উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।” আমাদের পৃথিবীতে, আমাদের সমাজে, আমাদের চিন্তায় এক বিরাট বিপুল অংশকে বিত্তের নিক্তিতে, চিন্তার নিক্তিতে, গায়ের রংয়ের নিক্তিতে, দেশ ও ভুগোলের নিক্তিতে, বিশ্বাসের নিক্তিতে অপর ( Other) ভেবে কী একটি গণতান্ত্রিক সমাজ হয়?

রবীন্দ্রনাথের বোঝাপড়া কবিতার শেষ চরণগুলোই তাই কাজের হয়ে ওঠে….
“মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে “

ছবি ঃ আমেরিকার কৃষিতে কর্মরত মেক্সিকান শ্রমজীবী মানুষ