যে জীবনে আমি গৌরব বোধ করি

এপ্রি ২৪, ২০২৩

সময়টা বোধ করি তেমন ছিল । মধ্যবিত্ত এক পরিবারে জন্ম আমার । অভাব দেখিনি কখনো। বিলাসিতা ও নয় কখনো। নিয়ম করে স্কুলের পোষাক, উৎসবে আর এক প্রস্থ । স্কুলে যাওয়ার অপশন ছিল রিক্সা বা বাস। আমার বাবা রিক্সা ভাড়াই দিতেন। যদিও আমি বাস বেছে নিয়েছিলাম। শহর এলাকার মুড়ির টিন বাস। কখনো পাদানীতে পা রেখে , আস্ত শরীর বাইরে ঝুলিয়ে রেখে বাস জার্ণি। ঘেমে নেয়ে স্কুল যাওয়া । তবুও খারাপ লাগত না। আসা যাওয়ার ৬ টাকা রিক্সা ভাড়া পেতাম । বাস ভাড়া ছিল ৬৫ পয়সা করে ১ টাকা ৩০ পয়সা । থেকে যেত আরো ৪ টাকা ৭০ পয়সা । তা থেকে লাঞ্চ ১ টাকার ডিম চপ। অবশিষ্ট থাকে ৩ টাকা ৭০ পয়সা । বাংলা একাডেমীর ‘শিশু ‘ তখন ১ টাকা । আর ‘নবারুণ ‘ ২ টাকা মাত্র । দুদিনের সঞ্চয়ে একটা দস্যু বনহুর। ১২ টাকার মাসুদ রানা। সেবা প্রকাশনীর বই। কালে কালে ওয়েস্টার্ন সিরিজ। এলো তিন গোয়েন্দা । মুসা – কিশোর- রবিন। কখনো হেঁটে ফেরা । এই জমানো টাকা থেকেই ২২০ টাকার ক্রিকেট ব্যাট কেনা। আহা , কী যে সব দিনগুলো ।

স্কুল ছাড়িয়ে কলেজ জীবন। ক্লাস সিক্সে পাওয়া ৬ টাকা শেষ হয়েছিল ১২ টাকায় । তখন ক্লাস টেন । ভর্তি হলাম মহসিন কলেজে । তখন পাই ২০ টাকা। প্রমোশন । কিন্তু, ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল রাজনীতিতে । কলেজ যাই। ফিরি দারুণ ফজল মার্কেটে। ভাত খাই দুপুরে ১০ টাকায়। ডিম ভাত। গরুর গোস্তে ২০ টাকা। সবজিতে ৮ টাকায় । দারুণ ফজলে কর্মসূচি নেই। বাসে চড়ে নামি কদমতলী। হাঁটতে শুরু করি। রেল লাইন পেরিয়ে মতিয়ার পুল, কাটা বটগাছ, মোগলটুলী, বড়ুয়া পাড়া। বাদামতলী হয়ে সিজিএস কলোনি, টিএন্ডটি কলোনি, পোস্টাল কলোনি, সিডিএ, সোনালী ব্যাংক কলোনি, বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনি, বহুতলা , গোসাইলডাঙ্গা হয়ে , আমিন ভবন। দিন কেটে গেছে । ক্রমশঃ মাস ও বছর ।

পৃথিবীর পথে হাঁটি। পৃথিবীর আলো খুঁজি। সাপ্তাহিক ” একতা ” ফেরী করি। বাবা ফেলে দেয় একতা’র বান্ডেল। ফেরিওয়ালা বলে গাল পাড়ে। ছোটদের রাজনীতি, অর্থনীতি হয়ে সাম্যবাদের ভূমিকা পড়ি। আগ্রাবাদ ১০ তলা ভবনের মাঠে গোল বৈঠক করি । নুরুল ইসলাম নাহিদ এর পাঠানো চিঠি পড়ি। শিবিরের হামলায় আহত অয়ন বড়ুয়া ‘র কাছে নাহিদ সাহেব এর সহমর্মিতায় বুক বাঁধি । আমাদের বন্ধু সাইফুল ইসলাম তখন গেল মস্কো। তার লেখা চিঠি পড়ি । দশ কোপেক এ প্রাভদা, এক রুবল এ মস্কো ঘোরার গল্প শুনি। কানে বাজে আজো ” দাস বিদানিয়া” মানে বিদায়। তখনো জানিনা, সাইফুল এর সাথে ও চির বিদায় ঘটে যাবে শীঘ্র ।

তখনো মিল্টন বড়ুয়া হাঁটছেন। একদিন দেখা হল তাঁর গ্রামে । হুলাইন ছালেহ নুর কলেজ এর সাথে। তিনি তখন স্কুল শিক্ষক । মাটির কাছে আবাস। মেধাবী ছাত্র মিল্টন দা। বহুকাল পরে জীবন তাঁকে নিয়ে গেছে আমেরিকা । অথচ, তিনি তো বেছে নিতে চেয়েছিলেন মাটির জীবন । মাটির মানুষ হয়ে । মাটিতে বিপ্লব এর ফসল ফলাবেন বলে। তিনি আজো মাটির মানুষ । জীবন পাল্টে দেয়নি তাঁকে এতটুকু । তবুও যা তিনি চেয়েছিলেন তা আর হলো কৈ ?

সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরতেন দীপক দে। কেউ কেউ তাকে ঠাট্টা করে সাদা দীপক বলতেন । তিনি নির্বিকার । তিনি ঘর থেকে ঘরে হেঁটে যেতেন। কখনো বিপ্লব এর ঘরে। কখনো হিল্লোল । কখনো অয়ন। শাহেদ। হাসান। হারুন ভাই। সাইফুল । বয়স চলে গেছে । চাকরি হয় না তার । পরিণত বয়সে হোমিওপ্যাথি, মাস্টারি, আর কত ? শেষে স্ট্রোক করে বিছানায় ।

আমাদের সেই কালে নুরুচ্ছাফা ভুঁইয়া এত সক্রিয় । এখনো মনে হয় তেমন । বন্দরে চাকরি জীবন শেষ করেছেন মাত্র কদিন হল । কখনো শুনিনি বা দেখিনি একটা ঘুষের পোস্টিং এ যেতে তদবির করতে। বরং, সে জায়গা বেছে নিতে চেয়েছিলেন যেখানে সময় বেশী দেয়া যাবে রাজনীতিতে।

বন্দরে সিবিএ নেতা আর হতে ইচ্ছুক নেতাদের জগতে মনে পড়ে , মান্নান শিকদার এর কথা। জীবনের সহজ শর্তে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন পরিবর্তন, আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর লক্ষ্যে ।

আমাদের সেই সব কাল বিগত হয়ত। তবে , জীবন এর বিপুলা বিস্তারে যাঁরা জীবনের মানে খুঁজে বেড়াতেন, সামষ্টিক জীবনের পরিবর্তন এর জন্য, আমি একদিন সেই সব মানুষের কাতারে পা মিলিয়ে ছিলাম । কী হল ? আর , কী হলো না? এইসব হিসেব এর বহু উর্ধ্বে জীবনের জন্য জীবনের নিবেদন।

সব গল্প অপ্রাপ্তির নয়। সব হিসেব খাতায় ভর্তি করার নয়।
কখনো কখনো হিসেব করতে হয় , উদ্দেশ্য আর সমর্পণে, নিবেদনে।

সেই সমর্পণ আর নিবেদন আমাকে শির দাঁড়া খাড়া রাখার সম্মান দেয়।

আমি আত্নসম্মান বোধ করি। কখনো ক্ষুদ্র অহংকার ।