সংক্ষিপ্ত পাঠ পর্যালোচনা : আলতাফ পারভেজ এর “জুলফিকার আলী ভুট্টো:দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায়”

এপ্রি ২৪, ২০২৩

২৪ বছর বয়েসী পাকিস্তানের দু অংশের একটি খসে পড়ার বিপর্যয়ে- লজ্জায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এর সামনে টানা দু’যুগের নেপথ্য ও প্রকাশ্য সামরিক জান্তা মুখ বাঁচানোর পথ খুঁজতে চাইছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণের ৯৬ ঘন্টা না পেরোতেই পাকিস্তান বেছে নেয় ভুট্টোকে। অক্সফোর্ড – বার্কলে পড়া ৪৩ বছরের বাগ্মী রাজনৈতিক ব্যক্তি। আড়াই লক্ষ একর জমির মালিক বৃহৎ সামন্ত জমিদারের পরিবারে তার জন্ম। যিনি নিজেই এক দশকের আইয়ুব শাহীর মন্ত্রী ছিলেন, একাত্তরে পাকিস্তানী সামরিক আগ্রাসনের সাফাই গেয়েছেন, তিনিই যথাসময়ে সব দায় আইয়ুব -ইয়াহিয়ার কাঁধে চাপিয়ে নিজেকে স্থাপন করেছেন জাতির অনিবার্য ত্রাতা হিসেবে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মন্ত্রীত্ব আর ৪৩ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রীত্বের চেয়ারে বসে প্রমাণ করেছেন রাজনীতির কুশলী খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কারো চেয়ে কম পারদর্শী নন।

বাম – মধ্য বাম – মধ্য ডান – ডানপন্থীদের একত্রে পাশে বসিয়ে নিজেকে স্থাপন করেছিলেন কেন্দ্রে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি ( পিপিপি) গঠন করেছিলেন তখনই যখন আইয়ুবী জমানার অন্তিমদশা আসন্ন। সমাজতন্ত্র – ইসলামি সমাজতন্ত্র – একচেটিয়া পুঁজিবাদের অবসান – ভূস্বামীদের ভূমির একচেটিয়ার অবসান – গণতন্ত্র এরকম একগাদা প্রতিশ্রুতি আর বক্তব্যর বহর নিয়ে তার আবির্ভাব। দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রধানত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আর ট্রেড ইউনিয়ননিস্টদের সাথে নিয়ে। ক্রমাগত বামপন্থীদের বিদায় করেছেন। আর কাছে টেনেছেন ডানপন্থীদের। ভূস্বামীদের টেনেছেন বড় পরিসরে। শহুরে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত তার কথায় ভরসা রেখেছেন। সব শেষে তিনিই পিপিপি আার পিপিপি মানে ভুট্টো।

উচ্চবর্গীয় মানুষের অহং, বাক চাতুর্য, পশ্চিমী কেতা ও জ্ঞান এর সংস্পর্শে সামন্ত সংস্কৃতির পাকিস্তানে তিনি আশার কুহেলিকা ছড়িয়েছেন। জিহ্বার ক্ষুরধারে যেমন বিরুদ্ধ পক্ষকে সমালোচনা করতেন, তেমনি ইতিবাচক সমালোচনা গ্রহণেও ছিলেন চুড়ান্ত অনীহ। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির ধারায় ইচ্ছেমত বদলেছেন নিজের রাজনৈতিক অবস্থান আর আদর্শ। বক্তব্য আর নৈতিক অবস্থান তার কাছে ওকালতি বিদ্যার কৌশলী বাহাস।

জীবনের উজ্জ্বল পর্বে জনপ্রিয়তা ও জনগণের বিপুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। সামন্ত সংস্কৃতি যে ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র, স্তাবকতা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, জেদ, কানা ঘুপচি পথে হাঁটে কোনোটায় তার অরুচি ছিল না। তবে বুদ্ধির ঝলকে, ব্যক্তিত্ব আর চাতুর্যে সামরিক জান্তা থেকে ক্ষমতা জনগণের ভোটের বাক্সে নিয়ে আনার সাফল্য তাকে দিতেই হবে। তবে, এ পথেও সামরিক জান্তার একাংশের সাথে আঁতাত ভুলে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই।
আবার জনবিচ্ছিন্নতার পথে হেঁটে ভোট জালিয়াতির অভিযোগের তীরেও তিনি বিদ্ধ।

তরবারি হাতে যে ঘোড়ায় চড়েছিলেন পিপিপি’র পোস্টারবয় হয়ে , সে ঘোড়া বড় নিষ্ঠুর। তিনি যে নিষ্ঠুর পথে হাঁটতে দ্বিধাবোধ করেননি, তার প্রতিপক্ষও সে একই খেলায় কসুর করেনি। জীবন দিয়েই তার মূল্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

গোটা দক্ষিণ এশিয়া পরিবারতন্ত্রের কৌলিন্যকে ধরে রেখেছে প্রায় সর্বত্র। কুলীন শ্রেণির বৈষয়িক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে কুলীন বংশীয় রাজনীতি আজো সমকালীন ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে। কিন্তু, ক্রমাগত এই কৌলিন্যের রাজনীতি এইসব জাতিকে কী দিয়েছে? গোটা বইয়ের নানান প্রান্তে সেই জিজ্ঞাসা পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন আলতাফ পারভেজ।

আফগান সংলগ্ন সীমান্ত প্রদেশে ভুট্টোর হাত ধরেই উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। ভোটের রাজনীতিতে পাকিস্তানের উগ্র মৌলবাদী শক্তির ভোট প্রাপ্তি যৎসামান্য হলেও, ভুট্টো তাদের দাবী দাওয়ায় মদদ দানের যে প্রক্রিয়া শুরু করেন, তা পরবর্তী দশকে আরো বহু বিস্তৃত হয়েছে। বিরোধী মত ও দলকে নিপীড়নের যে চর্চা তিনি বিশেষ বাহিনী নির্মাণ এর মধ্য দিয়ে চালু করেন, পরবর্তী দশকগুলোতে তা বিস্তৃত হয়েছে আরো বহুদূর।

একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে না পারলেও, তার ফাঁসি পরবর্তী দশকে তার দল পিপিপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। এখন অবধি একটি প্রভাবশালী দল হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয়। কিন্তু, সাধারণ অকুলীন কোটি কোটি মানুষের জীবনে এই কুলীন রাজনীতি কী দিয়েছে? নিজে এবং পরিবারের সন্তান সহ অপমৃত্যুর শিকার হয়েও রাজবংশীয় রাজনীতির নির্মাতা হিসেবে ইতিহাসে সাফল্যের দাবীদার ভুট্টো। কিন্তু, সাধারণ মানুষের কী লাভ তাতে? যে কুলীন রাজনীতির কাছে গোষ্ঠী স্বার্থ, কুলীন শ্রেণির স্বার্থ, তাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা সামরিক – বেসামরিক আমলাচক্রের স্বার্থের অধিক কোন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেই কথিত ” কুলীন” গোষ্ঠীর “কুলীন” রাজনীতিকে অতিক্রম করা ব্যতিরেকে জনগণের কল্যাণ অধরাই থেকে যাবে। আলতাফ পারভেজ এর ইতিহাস বয়ানে বরাবরের মত এ গ্রন্থেও আপামর মানুষের মুক্তি আকাঙ্ক্ষা এভাবেই ধরা দিয়েছে।

ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ও মুক্তি প্রত্যাশী মানুষের জন্য এ গ্রন্থ অবশ্য পাঠ্য।