স্বপ্ন দেখব বলে

এপ্রি ২৭, ২০২৩


মন ভরে আছে বেদনায় । মানুষ কি করে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে ? মানুষ কি করে এমন হতে পারে ? ক’টি টাকার জন্য ? লোভের জন্য ? অস্তিত্বের জন্য ? কি করে? কেমন করে ? আর, কেবল বিশ্বাসের জন্যও ! মানুষ পারে এমন করে মানুষ খুন করতে ? এই হত্যা ও নিষ্ঠুরতা আমাকে কাঁদায়, বিচলিত করে। আমি আর আমাতে থাকিনা।

‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে মা ঝুলে পড়েছেন গলায় দড়ি দিয়ে । আর পারছিলেন না । আর না। এই পরাজয় আর মেনে নিতে পারেনি । এখানে ওখানে, যেখানে সেখানে এই পরাভব মেনে নিতে পারেননি মা । বার্লিনের দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, পূর্ব ইউরোপে মুক্তির রাজে যবনিকাপাত হয়েছে । মুক্তির নায়ক লেনিনের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হচ্ছে । অথচ, মুক্তির আকাঙ্খায় সেই মা’এর সন্তান বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে পুলিশের গুলিতে। এই মা ‘হাজার চুরাশি’ র মা । নিজের সন্তান , আর আরো আরো এত সন্তান এর আত্মদান তবে কি বৃথাই গেল ? মৃনাল সেন এর “মহাপৃথিবী” র মা পরাজিত হয়ে, পরাজয় নিয়ে, অবিশ্বাস নিয়ে, আশা হারিয়ে বাঁচতে চাননি ।

সন ১৯৯৩ । পাঁচিল উঠেছে । তেভাগা – টংক আন্দোলনের নায়ক মণি সিংহের পার্টি অফিসে । মণি সিংহ গত হয়েছেন তখন । মাত্র তিন বছর আগে । মুক্তির পতাকার সেনানীরা কেউ কেউ তখন, ভাংগা মন , ভাংগা দেয়াল ভুলে নতুন দেয়াল গড়ে তোলাটাকেই মোক্ষ ভাবছেন । আর কেউ কেউ লড়াই জারী রাখাটাকেই উত্তম ভাবছেন । মতবিরোধের সমাধান অফিসে পাঁচিল তোলো । আর সেদিন পল্টনের এক হোটেলে একাকী পর্যুদস্ত, বিপর্যস্ত সেনানী ঝুলে পড়ল হোটেল কক্ষের ফ্যানের রশিতে । অবিশ্বাসের জীবন থেকে তিনি মুক্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন ।

“মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ” এই বাণী দিয়ে কবিগুরু যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, তখন বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন মানুষের বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটছিল । ফ্যাসিবাদ সারা দুনিয়ার মানুষকে তাড়াচ্ছিল। ছুটছিল মানুষ । যুদ্ধের দাবানল থেকে বাঁচতে । কেউ বা যুদ্ধের দাবানল মোকাবেলায় । ফ্যাসিবাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তখন মানুষ পোড়ানো হচ্ছিল। ফ্যাসীবাদের পরাজয় ঘটেছিল । পাঁচ কোটি ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু । আর শত কোটি মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ আর বেদনার বিনিময়ে । ভাবা হয়েছিল, এক দীর্ঘ রজনীর অবসান । ফ্যাসীবাদ আর মাথা তুলে দাঁড়াবে না । মানুষ এবং মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাই শেষ কথা , ফ্যাসীবাদ নয় ।

বর্ণের উপর বর্ণের, বিশ্বাসের উপরে ভিন্ন বিশ্বাসের, মত ও পথের ভিন্নতার উপরে ভিন্ন মত ও পথের, সংখ্যালঘিষ্ঠের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী নতুন কিছু নয় । সেই শ্রেষ্ঠত্ব আরোপের চেষ্টা, সেই শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধ মতবাদ ধারণকারীদের নির্মূলের চেষ্টা, হেনস্থার চেষ্টা আর এককেন্দ্রিক , এক চিন্তার , এক বিশ্ব গড়ার চেষ্টা অভিন্ন । এই চিন্তা আসল শত্রুকে আড়াল করে দেয় । দৃষ্টিকে ধুসর করে দেয় । বিভ্রমে আচ্ছন্ন করে দেয় । লড়াইয়ের মুখ ভোঁতা করে । কারণ, মানুষ বিভ্রমে ডুবে যায় ।

একটি আপাতঃদৃষ্ট প্রায় নিরুপদ্রব রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড । গোটা বছরের সহিংসতা ও খুন খারাবীর দ্বিগুণ রক্ত বইয়ে দিল একজন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শে দীক্ষিত মানুষ । হাত পা মাথা ওয়ালা আপাদ মস্তক দৃশ্যতঃ মানুষ কি করে এমন রক্ত পিপাসু হতে পারে ? এই লোক তো কোন মায়ের গর্ভেই জন্ম নিয়েছে । অস্ট্রলিয়া সেই দেশ, যেখানে ভূমিপুত্ররা আজ সংখ্যালঘুই নয় , মূলধারার সমাজে প্রায় অদৃশ্য । সেই ভূমিপূত্রদের মেরে কেটে সাফ করে, সাদা বংশোদ্ভূতরা নয়া অষ্ট্রলিয়া নির্মাণ করেছে । শুধুমাত্র অষ্ট্রলিয়ার ইতিহাস আর সাদাদের উজ্জ্বল জীবন যাপনের ইতিহাসের সাথে পরিচয় থাকলেও কি কোন মানুষ এমন হন্তারক হতে পারে ? তবুও তো হোল। এর নামও ফ্যাসীবাদ । শ্রেষ্ঠত্বের চিন্তা । মহৎ নয়, হন্তারক।

লিখতে গেলে সাতকাহন হয় । সারা দুনিয়াব্যাপী শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের হামলা চলছেই । টুইন টাওয়ার থেকে নরওয়ে । কাশ্মীর থেকে হোলি আর্টিজান । রাখাইন প্রদেশ থেকে ফ্রান্স । সর্বত্রই শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের আকাংখা জারী রাখা আর জিঘাংসা । কে কবে, কারা কবে নির্মূল করতে পেরেছে চিন্তার, বিশ্বাসের ? কেউ না । কেউ না । তবুও, বিরুদ্ধ মত ও চিন্তাকে দাবিয়ে রেখে ফ্যাসিস্টরা চেয়েছে কবরের শান্তি ।

বিশ্বাস নেই আজ । দরকারও নেই । প্রয়োজন আস্থার। প্রয়োজন পারষ্পরিক সম্মানের । প্রয়োজন গ্রহণ ও বর্জনের । তারও বেশী প্রয়োজন মিথষ্ক্রিয়ার । দেব আর নেব, মিলাবো মিলবো । এই লোভ জর্জর দুনিয়ায় আজ যা বড্ড বেশী প্রয়োজন ।

যা খুঁঝছি তা তো পাচ্ছিনা । যে পৃথিবী খুঁজছি তা তো আর মিলছে না । কোথাও না। তবে কি? ঝুলে পড়ব কোথাও ? না , প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের স্বপ্ন দেখব। যার দেখা মিলছেনা আজো ।