Yuval Noah Harari ‘র Homo Deus থেকে অংশবিশেষ( নিকোলাই চসেস্কু’র অসমাপ্ত শেষ ভাষণ ও রোমানিয়ার একনায়কতন্ত্রের অবসান)

এপ্রি ২৪, ২০২৩

২১ ডিসেম্বর ১৯৮৯। রোমানিয়ার তৎকালীন একনায়ক নিকোলাই চসেস্কু বুখারেস্ট নগরীতে আয়োজন করলেন এক বিশাল জনসমাবেশের।এর পূর্ববর্তী মাসগুলোতে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসকদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করেছে, বার্লিন দেয়াল ধ্বসে পড়েছে, খড়কুটোর মত ভেসে গেছে পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার শাসকেরা। ১৯৬৫ সাল থেকে ক্ষমতাসীন নিকোলাই চসেস্কু তখনো বিশ্বাস করতেন, তিনি এই সুনামী রুখতে সক্ষম হবেন। যদিও ইতোমধ্যেই, রোমানিয়ার একটি নগর তিমিসোরায় ( Timisora) ১৭ ডিসেম্বর,১৯৮৯ এ বড় বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বুখারেস্টে চসেস্কুর এই বিশাল জমায়েতের উদ্যোগ এর উদ্দেশ্য ছিল রোমানিয়াবাসী এবং বিশ্ববাসীকে জানানো, রোমানিয়ার বিপুল জনতা তখনো তাঁকে ভালোবাসেন বা নিদেনপক্ষে তাঁকে তখনো ভয় করেন। ভঙ্গুরদশায় উপনীত পার্টি সংগঠন সিটি সেন্ট্রাল স্কয়ারে প্রায় ৮০,০০০ মানুষকে একত্রিত করলেন। সমগ্র রোমানিয়াবাসীকে নির্দেশ দেয়া হল, তাঁদের সকল কাজকর্ম বাদ দিয়ে টিভি ও রেডিও শোনার জন্য।

চসেস্কুর সেই বিখ্যাত ভাষণ

ইউটিউব ক্লিপে দেখা যায়, চসেস্কু তখন আরেকটি দীর্ঘ বাক্য শুরু করতে চলেছেন। বলতে শুরু করেছেন ” আমি বুখারেস্ট এর এই মহতী আয়োজন এর উদ্যোক্তা ও সংগঠকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কারণ এটা…. ” ( I want to thank the initiators and organisers of this great event in Bucharest, considering it as a…..) এবং তারপরই তিনি নীরব হয়ে গেলেন। খোলা চোখে যা দেখলেন, তা বিশ্বাস করতে না পেরে যেন স্থির হিমায়িত হয়ে গেলেন। তিনি আর কখনোই সেই বাক্য শেষ করতে পারেননি। আপনি দেখতে পাবেন সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশের মধ্যে সারা পৃথিবী কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেল। দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে কেউ একজন ব্যাঙ্গাত্মক ধুয়ো ধ্বনি তুললেন। মানুষ আজও তর্কে মেতে ওঠে সেই প্রথম ব্যক্তিটি কে ছিলেন যিনি এরকম ব্যাঙ্গাত্মক ধ্বনি উচ্চারণের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন? তারপর আর একজন ধুয়ো ধ্বনি দিলেন। অতঃপর আরেকজন। আরেকজন৷ আরেকজন। এবং কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যে বিপুল জনতা সিঁটি বাজালেন, অজস্র ব্যঙ্গাত্মক ধ্বনি তুললেন এবং গগনবিদারী আাওয়াজ উঠল ” তি – মি – সো- রা! তি – মি – সো- রা!”

আপাতদৃষ্টিতে উৎফুল্ল ও উদ্দাম জনতার পানে তাকালেন চসেস্কু। তিনি যেন ফিরে গেলেন পূর্ববর্তী দশকগুলোতে। স্ত্রী এলেনা, নেতৃস্থানীয় পার্টি কর্মকর্তা, বিশ্বস্ত নিরাপত্তারক্ষীদের পাশে নিয়ে তিনি শুরু করলেন তাঁর চিরাচরিত একঘেঁয়ে ভাষণ। আট মিনিট ধরে তিনি রোমানিয়ার সমাজতন্ত্রের গৌরবগাঁথা তুলে ধরলেন। নিজেই খুব সন্তুষ্ট বোধ করছিলেন জনতার বিপুল যান্ত্রিক করতালিতে। তারপর হঠাৎ ছন্দপতন। ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন নিজেই। সার্চ বাটন চেপে লিখুন “Cheasescu’s last speech” এবং দেখে নিন ইতিহাসের গতিধারা।

এ সমস্তই ঘটে চলছিল রোমানিয়ার টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারকালে। যখন রোমানিয়ার তিন চতুর্থাংশ মানুষ টিভি পর্দায় চোখ আটকে রেখেছেন আঠার মত। তাঁদের হৃদয় কেঁপে উঠছিল। কুখ্যাত গোপন পুলিশ, নিরাপত্তা বাহিনী তৎক্ষনাৎ নির্দেশ দিল সরাসরি সম্প্রচার বন্ধের। কিন্তু, টেলিভিশন কর্মীরা তা অগ্রাহ্য করলেন। ক্যামেরাম্যানেরা তাদের ক্যামেরা উর্ধমুখী করলেন। কিন্তু, শব্দ ধারণকারীরা রেকর্ডিং চালিয়ে গেলেন। টেকনিশিয়ানরা চালিয়ে রাখলেন সরাসরি সম্প্রচার। সারা রোমানিয়া শুনল জনতার বিপুল ব্যাঙ্গাত্মক ধুয়ো ধ্বনি। তখনো চসেস্কু বলার চেষ্টা করছেন, ” হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো! ” যেন মনে হয়, সমস্যাটা মাইক্রোফোনের। তাঁর স্ত্রী এলেনা জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ” শান্ত হোন।শান্ত হোন। “
এলেনা থামলেন, যখন চসেস্কু রেগে তাঁকে বললেন, ” তুমি শান্ত হও।” চসেস্কু উম্মত্ত জনতাকে আবেদন জানালেন,
” কমরেডস! কমরেডস! শান্ত হোন। শান্ত হোন কমরেডস! “

কিন্তু, কমরেডরা আর শান্ত হতে ইচ্ছুক ছিলেননা। কমিউনিস্ট রোমানিয়া চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল যখন বুখারেস্টের সেন্ট্রাল স্কয়ারে সমবেত ৮০,০০০ মানুষ উপলব্ধি করেছিলেন, বারান্দায় দাঁড়ানো ফারের টুপি পরিহিত বৃদ্ধ মানুষটির তুলনায় তাঁরা অনেক বেশি শক্তিশালী।