চিত্রকলা বোঝার মত সমঝদার মানুষ আমি নই। সাধারণের মতই কেবল ভালো ও সুন্দর লাগা এবং মনে আনন্দ বোধ করার অতিরিক্ত কোন জ্ঞান আমার নেই। অনলাইনে কোন টিকেট ছিল না । অনলাইন চার্জ এর তিনগুণ বেশি চার্জ দিয়ে আমরা জায়গা করে নিলাম একটা গ্রুপ ট্যুরে। হাজার হাজার দর্শক। তারপরও খুবই সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন এগোয়। আমরাও পিছু পিছু। অন্যান্য গ্রুপ ট্যুর এর মতই বর্ণনাকারী গাইডের কাছে মাউথপিস। আর সকল অংশগ্রহণকারী গ্রুপ সদস্যদের গলায় অডিও ডিভাইস। কাজেই বর্ণনাকারী লঘু স্বরে বললেও শুনতে অসুবিধা নেই। অনেক অনেক গ্রুপ একত্রে ভ্রমণ করলেও হই চই নেই। সুশৃঙ্খল ভাবে নিরাপত্তা তল্লাশি শেষে আমরা ঢুকে পড়ি ভ্যাটিকান রাষ্ট্রের মিউজিয়ামে। মিউজিয়াম এর বিভিন্ন ফ্লোরের এক্সটেনশন থেকে ভ্যাটিকান এর ভেতরেও খানিকটা দেখা যায়।
যাই হোক মিউজিয়ামে প্রবেশের আগে সিসটিন চ্যাপেল ও দ্য লাস্ট জাজমেন্ট এর মুদ্রিত ছবির
স্ট্যান্ড এর সামনে দাঁড়িয়ে চলে ছবির খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা। তারপর মুল মিউজিয়ামে প্রবেশ। হাজার হাজার ছবির সমারোহ। অসংখ্য স্বনামখ্যাত, বা স্বল্পখ্যাত চিত্রকর এর কাজ। টাকার অংকে ছবিগুলো অমূল্য। এর মধ্যেই মাইকেলেঞ্জালোর সিসটিন চ্যাপেল ও দ্য লাস্ট জাজমেন্ট সবচেয়ে বিখ্যাত। মিউজিয়াম এর অধিকাংশ চিত্র, অজস্র ভাস্কর্যের বেশিরভাগই বাইবেল ও খ্রিস্টীয় নানান ধর্মীয় মিথকে কল্পনার সব রং দিয়ে তৈরি। এ মিউজিয়ামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সিলিং পেইন্টিং। ওয়াল পেইন্টিং তো রয়েছেই। অসংখ্য ভাস্কর্যের মাথা নেই। আবার অসংখ্য ভাস্কর্য কেবল মুখাবয়ব নিয়ে, কিন্তু সমগ্র শরীর নেই। সিলিং পেইন্টিং অর্থাৎ, ছাদে আাঁকা শিল্পীর জন্য শারীরিকভাবেই খুবই কষ্টকর। ২০ মিটার উঁচু ছাদে ঘাড় বাঁকিয়ে সামনে পেছনে ব্রাশ চালানোর দৃশ্যটা কল্পনা করাও কষ্টকর বৈকি। মিউজিয়ামের প্রতিটি ফ্লোরে উঁচু উঁচু ছাদের অসাধারণ সব সুন্দর ছবিগুলো যাঁরা একেছেন, তাঁরা শুধু দারুণ শিল্পীই ছিলেন তা নয়, তারো অধিক পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর একাগ্রতাও ছিল।
অজস্র শিল্পীর মধ্যে মাইকেলেঞ্জেলো জায়গা নিয়েছেন সবচেয়ে উজ্জ্বলতা নিয়ে। তিনি জন্মেছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সময়কালে। যখন শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলায় নতুন জোয়ার। পুরনো ধারণা – চিন্তা- ফর্ম ভেঙে নতুনের তোলপাড়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা তখন আাঁকা হয়ে গেছে। মাইকেলেঞ্জেলো দাঁড়িয়েছেন ভিঞ্চির প্রবল অস্তিত্বের মধ্যেই। “পিয়েতা” এবং নগ্ন মেষ বালক ” ডেভিড ” এঁকেই মাইকেল ২৫ বছর বয়সেই নাম কুড়িয়েছেন। থাকেন ফ্লোরেন্সে। তাঁর ডাক পড়ল রোমের ভ্যাটিকানে। যখন তিনি সিসটিন চ্যাপেল আঁকা শুরু করেন বয়স তখন ৩৩। চার বছর ধরে আক্ষরিক অর্থে শ্রমিকের মত পরিশ্রম করে সিসটিন চ্যাপেল আঁকা শেষ করেন তখন খ্রীস্টাব্দ ১৫১২, আার মাইকেল তখন ৩৭। তবুও তখন যুবক ছিলেন। আর যখন ” দ্য লাস্ট জাজমেন্ট ” আঁকতে শুরু করেছেন তখন তিনি ৬১ বছরের প্রৌঢ। এই বয়সেই তিনি সেই একই পরিশ্রম করে পাঁচ বছরে শেষ করেন এ ছবি। তখন সনের হিসাবে ১৫৪১। সিসটিন চ্যাপেল এর ফটো তোলা যায়। কিন্তু, দ্য লাস্ট জাজমেন্ট এর কক্ষে ফটো তুলতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। মোবাইলের ক্যামেরায় এ সৌন্দর্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার কিছু। অজস্র ভাববার কিছু। আনন্দকে ছুঁয়ে যাওয়া কিছু।
সিসটিন চ্যাপেল দেখা শেষ করেই যে কক্ষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, তা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে না যাওয়ার কোন কারণ নেই। এর দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার। একটা ফুটবল মাঠের সমান দৈর্ঘ্য সে কক্ষের। ওপরে সিলিংয়ে অসংখ্য শিল্পীর আাঁকা পেইন্টিং। দু’পাশের দেয়ালে অসংখ্য মানচিত্র। এ কক্ষের নাম জিওগ্রাফিকাল রুম। নীরস,স্থানু রেখাচিত্র নয় এই ম্যাপগুলো। শিল্পীর হাতের আঁচড়ে তা হয়ে উঠেছে অনিন্দ্য সুন্দর শিল্প। ছবির সংখ্যা, পরিমাণ, বিশালতা ও বৈচিত্র্যে এ কক্ষটিও কম যায় না।
সবশেষে দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। যাতে মাইকেল নিজের আত্মপ্রতিকৃতিও ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রায় ছয়শ বছর হতে চলল। এতটুকু ঔজ্জ্বল্য হারায়নি ছবিগুলো। বিশেষ কোন ক্যামিকেল ট্রিটমেন্ট করা হয়েছিল বা হয় কীনা আমার জানা নেই। তবে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই ছবিগুলোর আয়ুকাল পাঁচশত বছরের অধিক।
পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের এ বিপুল সমারোহের ডাকে ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে শুধু খ্রীষ্টধর্মে আকৃষ্টরাই ছুটে আসেন, মোটেও তেমন নয়। বরং সুন্দর এর ডাকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে ভীড় জমায়।