মার্কস এর মানুষের কাছে

জুন ৮, ২০২৩

আগামীকাল একটা অনুষ্ঠানে কিভাবে রেডিওতে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়, তা দেখানো হবে। এটা জানার আগ্রহ একজন মানুষের যার বয়স প্রায় ৭০। যে বয়সে আমাদের দেশে একজন মানুষ দুনিয়ার আর কিছু জানার নাই মনে করেন। দুনিয়াভি সব কিছু বাদ দিয়ে পরকালের জন্য সম্পদ সংগ্রহে মনোনিবেশ করাটাকেই একমাত্র কাজ মনে করা হয়। এখানে এই সুইজারল্যান্ডে এসে, পরকালের সম্পদ সংগ্রহে মনোযোগী থেকেও ইহকালের জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড কিভাবে কত সুন্দর ও সৃজনশীলভাবে যাপন করা যায়, তেমন একজন মানুষের সাথে আমার পরিচয় হোল। হানেছ ভেন্ড, আমার ছোট ভাই ও বন্ধু সহযোদ্ধা টিংকু র বন্ধু। টিংকু ৪৬। তার বন্ধু হানেছ।

গত ৩ দিন তার সাথে সাক্ষাৎ হল প্রতিদিন। প্রথমদিন মনে হোল হানেছ একজন বোটম্যান। নেভিগেশনে অভিজ্ঞতা আছে। নাবিকের জ্ঞান সমৃদ্ধ। সেইলিং বোট চালান। কী চমৎকার করে, সুন্দরভাবে সেইলিং বোট চালানো যায়, তা বললেন এবং করে দেখালেন। বাতাসে যখন বোট কাত হয়ে যায় একদিকে, তখন আমি ভাবতে থাকি, এই বুঝি ডুবে গেল নৌকা। হানেছ তখন হাসি দিয়ে বলে, এভাবে নৌকা ডোবেনা। কেউ ডোবাতে চাইলেও পারেনা। কখনোই না। সাঁতার না জানা আমি বিশাল হ্রদ এর মাঝে ভাসতে থাকা ছোট সেইলিং বোট এর সওয়ারী হয়েও আশ্বস্ত হই। আমি উপভোগের চেষ্টা করি প্রথম সেইলিং বোট জার্ণি।

গতকাল দেখা হানেছ এর হলিডে হাউজ। ১০০ বছরের পুরনো। যে বাড়ির তালা দেয়া থাকেনা। শুধু কাঠের বাড়ির কাঠের একটা পাল্লা ঘোরালেই দরজা খুলে যায়। হানেছ এর গ্রান্ড ফাদার এটা বানিয়েছেন। হানেছ এর বেশ ক’জন চাচা চাচী। আর, হানেছরাও নিজেরা ৯ ভাই বোন। দরজা ঠেলে ঢুকতেই নজরে আসে ফ্যামিলি ট্রি। হানেছ এর গ্রান্ড ফাদার এর সদস্য সংখ্যা গত ১০০ বছরে এখন ৩০০ জনের অধিক। হানেছ আমার চোখে তখন ফ্যামিলি ম্যান। বাড়িটার সামনে আল্পস পর্বত। একটা নয় বেশ কয়েকটি গ্রাম। একই আর্কিটেক্সার। কিন্তু, অপূর্ব সুন্দর। বাড়ির পিছনেও ফরেস্ট। গত শতকের একজন কৃষক ও তাঁর স্ত্রী’র বাড়ির সামনের পেছনের এ সম্পদ গড়ে উঠেছে শত বছরের মধ্যে।

গ্রিল পার্টি ছিল গতকাল। হানেছ নিজেই রাঁধে বাড়ে না। সে সকলকে নিয়ে কাজ করে। আমাদের ৪ জনের সকলকে নিয়ে সে কিছু কাজ করিয়ে নিল। রান্নার বিন্দু বিসর্গ না জানা আমিও শরীক হলাম তাতে। ক্লিনিং কাজটা করলাম।

ধীরে ধীরে জানা হল হানেছ একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক নয় শুধু, তার রয়েছে মিউজিক ব্যান্ড। সে পিয়ানো বাদক। গিটার বাদক। তার প্রোগ্রাম হয় । ৬/৭ শ জন তার শ্রোতা দর্শক হয়। দেখা হল তার কুকিং মেথড।


হানেছ এর হলিডে হাউজ যেন একটা মিউজিয়াম। ধারণা করি, এরকম অজস্র হানেছ রয়েছে সুইজারল্যান্ড জুড়ে।

আজ হানেছ এর বাড়িতে গেলাম ডিনারের নিমন্ত্রণে। হানেছ এর ফটোগ্রাফি দেয়াল জুড়ে। হানেছ এর ওয়ার্ক স্টেশন। প্রিন্টার। হানেছ এর ক্যালেন্ডার। যা সে বানায় কেবল ৫/৬ জন বন্ধুর জন্য। তার ফটোগ্রাফি দিয়ে।

আমি ভেতো বাঙালি বলে আমার জন্য রান্না করেছে ভাত দিয়ে। সাথে অন্য অনেক উপাদেয়। হানেছ আমাকে তার বারান্দা থেকে দেখালেন গ্রাফিতি। বললেন, ক্ষোভ ক্রোধ ব্যক্ত করলেন। তাঁর ভাষ্যে এ গ্রাফিতির কোন শিল্প মূল্য নেই। শুধু আত্ম প্রচার ছাড়া।

হানেছ একা থাকেন। কিন্তু, তিনি নিঃসংগ নন। তিনি বেঁচে আছেন সমস্ত সৃষ্টিশীলতা উপভোগ ও যাপনে।

এ জীবন মানুষের। যে জীবন কাঙ্ক্ষিত ছিল মার্কসের। হুবহু উদ্বৃতি দিলাম না। কথাটা এমন ছিল হয়ত, সকালে শিকারের জীবন যাপন করে ও দিনভর যাপন করা যায় সংগীত ও সাহিত্য নিয়ে।

বহুকাল তত্ত্বে জেনেও, আজ ৩ দিন হল। মার্কস এর কাঙ্খিত মানুষ আবিষ্কার।