একুশে যখন আত্ম পরিচয় হারিয়ে কেবলি আত্মমগ্নতা

ফেব্রু ২২, ২০২৪

শৈশব ছাড়িয়ে কৈশোরেই চিনেছি শহীদ মিনার। আরো অজস্র কিশোর এর মত একুশের ভোর মানে নগ্ন পদে প্রভাত ফেরী। শহীদ মিনারে পূস্পস্তবক অর্পণ। একুশের গান। কবিতা। নাটক। আবৃত্তি। লেটার প্রেসে কবিতাপত্র – ছড়াপত্র প্রকাশ। দু’টাকা পাঁচ টাকায় বিক্রি। আমাদের একুশ দীর্ঘ সারির দু লাইনের মিছিল। গলা ফাটানো শ্লোগানে মুখরিত। হাতে লেখা ব্যানার পোস্টার। শিল্পের, শিল্পীর সুষমায় উদ্ভাসিত।

আমাদের একুশ উদযাপন স্বৈরাচারী
বিশ্ববেহায়ার বিরুদ্ধে কবিতা উৎসব। রাজানুগ্রহের প্রলোভন এর বিরুদ্ধে তরুণ ও প্রবীণ কবির অংশগ্রহণে সোচ্চার। এরশাদের রাজকবি উৎসবের বিপরীতে জাতীয় কবিতা উৎসব। পটুয়া কামরুল হাসান কবিতা উৎসব এর মঞ্চে বসে আাঁকিবুকিতে আাঁকেন ব্যঙ্গচিত্র। প্রধান কবি শামসুর রাহমান সাহসী উচ্চারণ করেন সাহসী কবিতার পঙক্তি। নুর হোসেন এর উদোম বুক কবির কাছে ধরা দেয় ” বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ হয়ে।

আমাদের একুশ মিউনিসিপ্যাল স্কুল চত্বরে জমায়েত। আমাদের একুশ কারো কারো দোস্ত বিল্ডিংএ জমায়েত। আমাদের একুশ উদযাপনকালেই শুরু হয় ২০ ফেব্রুয়ারী বিকেল থেকেই শহীদ মিনারে মুজিব – জিয়া- তাহের এর ছবি টানানোর কুৎসিত প্রতিযোগিতা। আমাদের কালেই শহীদ মিনার একুশের প্রথম আলোর স্থলে গভীর রাতে ১২.০১ টায় আগে ফুল দেয়ার প্রতিযোগিতা। তবুও, দেয়ালের শ্লোগানে শৈল্পিক ভাষার উত্তর দেয়া হত তেমনি উপযুক্ত বিপরীত শব্দ দিয়ে।

আমাদের কাল আশির দশক। সংগ্রাম – লড়াইয়ের কাল। আমাদের কাল বেচাকেনার মওসুম শুরুর কাল। তবুও, নষ্ট হয়ে যায়নি তখনো সকল। কিন্তু, কালে কালে কালের অমানিশা গ্রাস করে সবকিছু।

আমারাই কী সে প্রজন্ম যে কালের পর আবারো আদর্শবাদীতা এক নিদারুণ উপহাস! বোকাদের কাজ! ঈশপের গল্পের নব সংস্করণ!

একালের গল্প : ব্যথা নয় বিষ্ময় –
ঢাক যখন বাজাতে হবে নিজের, তবে নিজেই বাজাও। অন্য কেউ বাজালে ঢাক ফেটেও যেতে পারে। কালের নয়া যাত্রা ধ্বনি আজ কান পেতে শোনা যায়। চোখ মেলে দেখা যায়। মিডিয়ার রাজ্যে ক্রীতদাস আমরা। খদ্দের মাত্র। জেনে, না জেনে অথবা জেনে বুঝেই আমরা তাতে সওয়ার হই। ছবি, ছবি আার ছবি। ফেসবুক – ফেসটাইম – সেলফি এ এক আত্মরতি। মুখ দেখাতে মুখবহি ( ফেসবুক) । এটাই স্মার্ট যুগ। যে যুগে কালে সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি তারাই যারা বিক্রী করেন বক্তৃতা। মোটিভেট করেন মোটিভেশনাল স্পীকার হয়ে? সব ডেল কার্নেগী। কী করে বিসিএস পাস? কী করে কর্তার মনজয়? কী করে প্রেম জয়? কী করে অধরা ধরা যায়? এ যুগ রেমন্ডের শ্লোগান এর মত কমপ্লিট ম্যান হবার। রেমন্ড স্যুট পড়লেই যা হয়ে যায়। এ যুগে আর্টিস্ট হতে হলে এপস্ যথেষ্ট। এ যুগে কবিতা নাকি এআই করে দেয়। এ যুগে মানুষ এক গাণিতিক ক্যালকুলেটর। এলগরিদম। সংখ্যা। সংখ্যার অভ্যাস, চাহিদা, যোগান এর গণিত।

এ যুগ কী তবে হিসাবের খাতা? নাকি আমাদের বোঝার অক্ষমতা?
তথাকথিত বোকা ও লাজুক কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন,
“বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!”
এ এক আজন্ম ও আমৃত্যু দুঃস্বপ্ন অথবা জীবনের পিছু পিছু হাঁটতে থাকা সওয়ারী। যতদুর যাই, যতকাল যায়, কেবল তাড়ায়। কারণ, মানুষের জীবন বোধ অবিনাশী। মানুষের কান্না ও হাসি বা তার বেদনা ও আনন্দ অনন্য। হিসাবের সব খাতা উল্টে দিয়ে মাম্মী ড্যাডী জেনারেশন এর ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, কোটা বিরোধী আন্দোলন, ট্রাফিক অনিয়ম বিরোধী আন্দোলন আমরা দেখেছি। নতজানু কবি ও সাহিত্যিক, নতজানু বিবেক বিক্রেতা, বুদ্ধি ও বৃত্তির ব্যবসাদার, পুঁজি ও লুটপাট এর পরমপরা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাওয়া পরম সিংহরা যা অনতিক্রম্য মনে করেন তাকে কত সহজ অবলীলায় চ্যালেঞ্জ করা যায় এ প্রজন্ম স্বাক্ষর রেখেছে। সুতরাং, এ প্রজন্ম কেবল বিসিএস, ক্যারিয়ার, আত্মরতির প্রজন্ম নয়। হয়ত আমাদের প্রাচীন চোখ আর তা ঠাহর করতে পারছে না।

কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি
শুনিয়া জগত রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল স্বামী
” আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি “

আমার একখানা বাসা ছিল ঢাকায়। একদা কখনো। নেই আার। সে ফ্ল্যাটের ভবনে সব কটা জাতীয় দিবসে পাতাকা ওড়ানো হয়। সে ফ্ল্যাটে আমার একজন নারী সাহসিকা দিদি থাকেন। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে থাকা কমরেড প্রসাদ রায় এর কন্যা তিনি Britwa Roy Dipa রাকসু’র নির্বাচিত ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদক ছিলেন। তিনি সকল ফ্ল্যাট মালিককে একত্রিত করে এ ছোট কাজটি নিয়মিত সম্পাদন করেন। ফলে, সেখানে প্রতিটি জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়।

আমি পেশায় একজন সাধারণ সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। এর এসোসিয়েশন এর ৫০ তম বছর এবার। গত বছর থেকে এ বছর। মানে ২ বছর। এ এসোসিয়েশন এর উদ্যোগে দুবার পালিত হল সাংস্কৃতিক উৎসব। ছবি আঁকা, হাতের লেখা, গান, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। সদস্য সন্তানদের জন্য। প্রায় একশত প্রতিযোগি অংশ নিল। আনন্দে বুক ভরে গেছে এসোসিয়েশন এর অনেক পুরনো কর্মচারী এসে যখন বলেছেন , এতটা বছরেও এরকম আয়োজন করা যায় এমন ভাবনাই তো কখনো উদ্রেক হয়নি।

যুগের দাবি
কাল, হাল ও যুগের চাহিদা ও রুচি পাল্টায়। কিন্তু, মানুষের আজন্ম লালিত মানুষের প্রাণের তাগিদ অভিন্ন। আমাদের দরকার আাজ আমাদের নবায়িত করা। কালকে নবায়িত জীবনের ছোঁয়া দেয়া। জীবন অবিনশ্বর ও বাঙ্ময় স্ব মহিমায়।

শেষের আগে: প্রতিবাদী এখন প্রতিবাদকে ভয় পায়:-

ফরাসী বিপ্লবের বয়সকাল ছিল প্রায় ১০০ বছর। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার শ্লোগান নিয়ে যে ফরাসী বিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে বিপ্লবের জনকদের অনেককেই পাঠানো হয়েছিল গিলোটিনে। যে কোন বিপ্লবের নেতারা যখন হয়ে ওঠেন সর্বশক্তিমান, তখন সবার আগে রাশ টানতে চান বৈপ্লবিক কার্যক্রমে। বিপ্লব অপরাজেয়। বিপ্লব সাহস। বিপ্লব পরিবর্তন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল রাজনৈতিক পরিচয় ধারণকারী ছেলে ধর্ষণ করল। ক্ষোভে উত্তাল তারুণ্য একটা গ্রাফিতি আাঁকল। ধর্ষণ বিরোধী ক্ষোভ নিয়ে। বহিষ্কার করা হোল জাহাঙ্গীরননগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে এক বছরের জন্য।

গণতন্ত্র চাই :-
একুশের আকাংখা ছিল গণতন্ত্র। মানুষ নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়। এর নাম গণতন্ত্র। মানুষ নিজের ভোট দিতে চায়। এর নাম গণতন্ত্র। মানুষ অধিকার এর কথা বলতে চায়। এর নাম গণতন্ত্র। মানুষ ক্ষোভ ও রাগ প্রকাশ করতে চায়। এর নাম গণতন্ত্র।

সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার এর স্বাভাবিক প্রকাশ এর অধিকার চাই। অধিক কিছু নয়। অনধিক ও নয়।

এটাই আমার একুশে।