দোস্ত বিল্ডিং চত্বর,চট্টগ্রাম থেকে ভিক্টোরিয়া, লন্ডন

মার্চ ২৩, ২০২৪

সে এক সময় এসেছিল এ জীবনে। যখন জলপাই জমানার দুঃশাসন চেপে বসেছিল বাংলাদেশে। যখন পটুয়া কামরুল হাসান জাতীয় কবিতা উৎসব এর মঞ্চে বসে স্কেচ করছিলেন ” দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে “। যখন নুর হোসেন এর বুক আর পিঠ হয়ে উঠেছিল শামসুর রাহমান এর কবিতায় ” বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ” হয়ে। নুর হোসেন জীবন দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ” গণতন্ত্র মুক্তি পাক ” শ্লোগান এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে।

সে কালে বিগত শতকের আশির দশকে আমরা একদল তরুণ রাজনীতিতে হাতে খড়ি নিয়েছিলাম। আমাদের পাঠ শুরু হবার দিনগুলোর উজ্জ্বল স্বাক্ষী হয়ে উঠেছিল নিউমার্কেট দোস্ত বিল্ডিং এর পাশে তৎকালীন স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক এর সম্মুখস্থ চত্বর। প্রতিটি ঘটনা ও দুর্ঘটনায় আমরা সমবেত হতাম এ চত্বরে। আমাদের সকল ক্ষোভ ও বিক্ষোভ প্রতিবাদ এর রুপে মুষ্টিবদ্ধ শ্লোগান হয়ে, মিছিল ও সমাবেশে ঝরে পড়ত। এছাড়াও, কখনো আমতলা, কখনো শহীদ মিনার, কখনো পুরনো রেল স্টেশন, কখনো লালদিঘীর লাল আগুনে আমরা ঝলসে উঠেছি।

কখনো ১৫ দল, ৭ দল। কখনো ৮, ৭, ৫ দল। কখনো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কখনো ২২ দলীয় ছাত্র সংগঠন। কখনো সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। অভিন্ন লক্ষ্য গণতন্ত্র চাই। ভোটাধিকার চাই। “আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।” তখনো নেত্রী হাসিনা ও খালেদা। বামপন্থার সংগ্রামীরা লড়ছেন তাদের পাশেই। যদিও ক্ষমতা বলয় থেকে তখনো বহুদূরে, এখন আরো সুদুরে।

নব্বই উত্তর জমানায় আমরা বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মিলে করলাম গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য। শ্লোগান দিতাম আমরা, ” সন্ত্রাস করে তিনটি দল লীগ- শিবির – ছাত্রদল”।

কিন্তু, আমরা যারা সেই সংগ্রাম মুখর দিনগুলোতে সমবেত হতাম, তারা যারা এ দিনগুলোর সংগ্রামের মধ্যে অনাগত ইতিহাসের কাছে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশা করেছি তারা সেই সব বামপন্থায় আস্থাবান তরুণ ও তরুণীরা আজ কোথায় কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আশির দশকের সংগ্রাম ও নব্বই দশকের সংগ্রামের মধ্যে দুটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন দৃষ্টি কাড়ত সকলের। একটি অপেক্ষাকৃত প্রবীণ সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন যা স্পষ্টতই সিপিবি’র প্রভাবিত , অপরটি মাত্রই জাসদ ফুড়ে বেরিয়ে আাসা বাসদ এর ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।

লড়াই – সংগ্রাম – সংগঠন – জোট- জীবন – বাস্তবতা এসব মিলিয়ে বামপন্থার এক বিচিত্র অবস্থা তখন। একদিকে বাস্তবতা হল সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পতন, পূর্ব ইউরোপের পতন। আর আমাদের আবৃত্তিকারকদের মুখে একটিই রব, ” তত্ত্ব সঠিক, প্রয়োগ ভুল। ” এ যখন অবস্থা একদিকে, আর অন্য পৃথিবীতে তখন তোলপাড় প্রযুক্তি জগতে তথ্য ভান্ডারে জ্ঞান ও বিজ্ঞান এর সংযোগ ও সংযোজন এর নয়া উল্লম্ফনে। কেউ কাউকে আমরা কানে কানে বলিনি, কেউ কারো সাথে যোগসাজশ করিনি। কিন্তু, আমরা বোধ করি বুঝতে দেরী করিনি, বিগত জমানার, বিগত শ্লোগান, আর বিগত চিন্তা আর নয়া সহশ্রাব্দে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে না, যদি না সে নয়া শতাব্দীর জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার মত যোগ্য না হয়ে ওঠে।

যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের শুরুর দিকে আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্বে তখন সৈকত আচার্য্য সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর নগর শাখার সদস্য সচিব ( সাধারণ সম্পাদক).। চাকসু মানে যা সর্বশেষ চাকসু’র জিএস আজিম ভাই তখন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর নগর শাখার আহ্বায়ক ( সভাপতি) । সৈকতের সাথে সাক্ষাৎ নেই গত তিন দশক। ছাত্র রাজনীতি ছাড়ার পরে। কথা হয় কখনো ফেসবুকে। মেসেঞ্জারে। এ প্রথম লন্ডন বেড়াতে এলাম। আসার আগে কথা হয়েছিল। দেখা হল আজ। একটা পুরো সন্ধ্যা চেয়েছিল সৈকত। সৈকত পেশায় আইনজীবী। আমার জীবন সঙ্গী সাবিনা পারভীন লীনাও ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

সুতরাং, আমি, সৈকত ও লীনা আমরা সকলেই পূর্ব পরিচিত ও একই মিছিলের শরীক। আজ, এ নগর লন্ডনে আমরা একত্রিত হলাম। আমাদের জীবন ও যৌবন উৎসর্গিত ছিল মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। জীবনের ঝড় আমাদের যেখানেই ছিটকে দিক না কেন, আমরা আমাদের মত করেই মহত জীবনের অন্বেষায় আছি।

আজ দিন অম্লান থাকুক। আজ সন্ধ্যায় আমরা দীর্ঘ আড্ডা শেষে বিদায় নিলাম যে স্টেশন থেকে, তার নাম ভিক্টোরিয়া।

দোস্ত বিল্ডিং চত্বর থেকে ভিক্টোরিয়া।
সংগ্রামীদের ঐক্য ও ভালবাসা নতুন সংগ্রামের মাঝেই খুঁজে নিক অনাগত দিনের সম্ভাবনা।