ইতিহাস নিয়ে বাহাস

এপ্রি ২১, ২০২৪

https://sarabangla.net/post/sb-869951

রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন?  কিংবা খোলাফায়ে রাশেদীন?  অথবা মোজেস – যীশু- বুদ্ধের দিন?
কিংবা সেই গ্রাম যা শান্তির নিলয়? আর্যউত্তর বা প্রাক আর্য,  খ্রীস্টপূর্ব বা খ্রীস্টাব্দ?  প্রমিজড ল্যান্ড বা সাম্য সমাজ? ইতিহাসের মাটি ফুঁড়ে ফিরে যাবেন সে যুগে?

কবেকার ইতিহাস আসল ইতিহাস?  কবে থেকে ঠিক ইতিহাস এর জন্ম হোল?  ইতিহাসের সত্যিই বা কী?  জ্ঞানী, জনমান্যবর, দ্রষ্টা, নেতা, পন্ডিত, ধর্মবেত্তা, গবেষক,  রাষ্ট্রনায়ক বা রাজা কিংবা আটপৌরে প্রজা সাধারণ?  কার বয়ান ইতিহাস?

ইতিহাস বলে আমরা যা জানি বা শুনি,  মানি কিংবা নাই মানি কোন ইতিহাস আসল ইতিহাস?  কোন ইতিহাসই বা সত্য কিংবা কোনটা মিথ্যা বয়ান আর কোনটা অর্ধ সত্য বা অর্ধ মিথ্যা?

মানব জনম।  জন্ম- বিকাশ- সৃজন- বিকাশ- বিস্মৃতি- বিলয়। জন্মের পর শৈশবের কতটা স্মৃতিই মনে রাখে?  বিলয়ে লুপ্ত হয় কতখানি?  বিকাশে – সৃজনে তার নিজের ভূমিকাই কতটা স্বাধীন? 

কোন একটা ঠিকানা পাবার ইচ্ছে নিয়ে যে মানুষ বা মানুষেরা হেঁটে বেড়িয়েছে, দৌড়ে বেড়িয়েছে, ক্রোশ নয় হাজার মাইল ছুটে চলেছে, পশুর পিঠে চেপে, পায়ের উপর ভর করে, ডিঙি নৌকায় পাড়ি দিয়ে,  পাল তোলা নৌকায় মহাসাগরের অনিশ্চয়তার মাঝে নিজেকে সঁপে, কালে কালে রেল বা যন্ত্র যানে বা গত শতক থেকে আকাশযানে, পৌঁছে গেছে কী সে বা তারা ইতিহাসের কাছে?  খুব কাছে?  অথবা মিলেছে কী তেমন সীমানা,  যার উঁচু পাঁচিলে চেপে দেখা দেয় এপার ওপার অসীমের মাঝে সসীম সবটুকু? 

তবুও, কালে কালে ইতিহাস রচনা করেছে মানুষ।  তার লিখিত ও কথ্য বয়ানে জন্ম পরষ্পরায় ইতিহাস রচে গেছে মানুষ।  তবুও,  ইতিহাস নিয়ে এত বিভ্রান্তি কেন?  ইতিহাস কী তবে দেখার চোখ অথবা মনের চোখে যেমন খুশি দেখবার কল্পনা শক্তি?  ইতিহাস কী তবে কল্লনার সলতে জ্বালানো?  রঙ -রস -রুপ -গন্ধ মাখা রোমহষর্ক বা আবেগপ্রবণতায় মাখানো মূহুর্তের সমষ্টি? সকলের মান্যতা পাওয়ার ঘটনা তো বিরল, তবে কী ইতিহাস সংখ্যা গরিষ্ঠের মান্যতা বা স্বীকৃতি পাওয়া?

ইতিহাস কী দূরের পানে যতদুর পারা যায় ততটাই দৃষ্টি নিবদ্ধ করা নয়?  যতদূরে দেখা যায় সে বয়ানে দাঁড়িয়ে যতটা প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়,  তা দিয়েই দৃষ্টিরও অধিক নানানরকম প্রকল্প সমষ্টি কী নয়? অবিশ্বাসী বা সংশয়ী হয়ে নয়,  ইতিহাস বয়ানে রচয়িতাদের সদিচ্ছা কী নির্মোহ থাকে?  যে জগতে আমরা সমকালে বাস করি বা আমাদের পূর্বসুরীরা বাস করতেন তাঁরাও তাদের সমকালীন চিন্তা,  দর্শন বা সামাজিক চাপের উর্ধে কী থাকতে পারতেন?  আপাতদৃষ্টিতে তা অসম্ভব মনে হয়।

ইতিহাসের নির্মোহ নির্মাতা বলে কিছু কী আছে বা থাকে?  ইতিহাস সমকালে দেখা অভিজ্ঞতা আর দৃষ্টিভঙ্গীতে অতীতের নির্মাণ প্রচেষ্টা। আর সমকালকে নিজের মত করে ব্যাখ্যার চেষ্টা।  ফলে,  একই ইতিহাসের অজস্র ভাষ্য হয়। বিপরীতমুখী ও দ্বন্দ্ব মুখর বা সমাধানের অযোগ্য জায়গায় আমরা উপনীত হই। তা নিয়েই লিপ্ত হই আমরা আরো দ্বন্ধ ও সংঘাত ডেকে আনি।

ইতিহাসের ভাষ্য কী পুনঃ নির্মাণ ও পুনঃ গঠন অসম্ভব?  যদি ইতিহাসের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়,  প্রতিটি কালপর্বের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও এর পাশাপাশি প্রাপ্ত অপরাপর ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে পাঠ করা যায়,  তখন ইতিহাসের একটা আপাতঃ অস্পষ্ট হলেও অনেকখানি সত্য নির্মাণ এর কাছে পৌঁছা সম্ভব।

বলা হয় যদি,  ইতিহাস হোল শাসকের বয়ান।  শাসকের জন্য বয়ান।  খুব ভুল হয়ত বলা হয়না। কারণ,  শাসকের তো ফরমায়েশি লোকের অভাব থাকেনা। অপেক্ষাকৃত ও তথাকথিত যোগ্য লোক তো শাসকের ছায়াতেই ইতিহাস নির্মাণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু,  তার বাইরেও মানুষের সম্মিলিত জীবন আর তার পদচিহ্ন তো নিজেই তো একটা ইতিহাস হয়ে রয়ে যায়।  যতই জোর খাটানো হোক না কেন, অথবা উচ্ছেদ এর চেষ্টা চলুক না কেন,  মানুষের সম্মিলিত জীবনের পদচিহ্ন মুছে ফেলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব।  মরেও সে বেঁচে থাকে। ফসিল হয়েও জানান দেয়,  সেও ছিল কোন একদিন।

কেনই বা ইতিহাস প্রাসঙ্গিক থাকে?  পাঁচশ বা পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস কেনই বা জেগে ওঠে বা তোলা হয়?  জেগে ওঠা ইতিহাস,  চালু ইতিহাস,  না জানা ইতিহাস কী করে প্রাসঙ্গিক থাকে বর্তমানেও?  তাতে কীইবা হয়?  ইতিহাসের নিজস্ব বয়ানে কী নিজের লাভ হয়? হোক সে কষ্ট কল্পিত কীংবা অর্ধসত্য বা কিংবা মিথ্যা বা কল্পনার রঙে মোড়ানো। ইতিহাসের কোন একদিকে রোশনাই জ্বালিয়ে অন্য দিকটায় নিকষ কালো অন্ধকার আরোপ করে স্বার্থসিদ্ধি যদি হয়,  তবে তাতেই শামিল হতে কসুর কেন!

মানুষের হাঁটতে শেখার কাল থেকে মানুষ পরিব্রাজক।  কোন এক নদীর তীরে,  কোন এক ভু প্রান্তরে,  কোন এক শষ্যের বীজ বুনতে বুনতে, কোন এক গুহার গহ্বরে,  কোন এক প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্ট বিপাকে যে ধারণা সে লালন করে সে ধারণার অতিরিক্ত নতুন ধারণা সে গ্রহণ করে নয়া জনপদে। দিয়ে আর নিয়ে, মিলায়ে মিলিয়ে সে অভিযোজিত হয়। নয়া নয়া জমানায় সে থিতুও হয়। আর থিতু হতে চাওয়ার কালে সে তার জন্য লাগসই ইতিহাসেরও জন্ম দেয়। সত্য আর মিথ্যা,  সত্য আর কল্পনা,  অনুমান ও নির্মাণ করে কল্পলোকে। কখনো ইচ্ছায় আর কখনো প্রয়োজনে।

ইতিহাস কতক নয় সহস্র- অযুত- লাখো ঘটনার ধারাবাহিকতা, মিথস্ক্রিয়া,  উল্লম্ফন এর যোগফল। ইতিহাস অন্ধের হস্তি দর্শন নয়। ইতিহাস নৈর্ব্যক্তিক,  অবিমিশ্র,  ঘটনার বিপুল পাটিগণিত নয় জটিল রসায়ন।

শাসকের বয়ানে বা শাসকের উপযোগী ইতিহাস প্রকল্প আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পরষ্পরের।  কাউকে বাদ দিয়ে,  কিছু বাদ দিয়ে আর কিছু সুবিধাজনক যোগ করে কোন এক কল্পকাহিনীতে ভর দিয়ে হয়ত বর্তমানকে কিছুটা দীর্ঘায়িত করা যায়,  শাসকের তা অজানা নয়। আর, আমরা আম জনতা তাতেই ছুটি,  তাতেই দৌড়ে বেড়াই অনেকটা।

মানুষ যেমন অযুত লক্ষ ঘটনা ও দুর্ঘটনার,  শরীর ও মননের অসীম সক্ষমতার মিলন মোহনা,  তেমনি মানুষের ইতিহাস তার অধিক কিছু নয়। পছন্দের রঙ দিয়ে রংধনু হয়না। প্রকৃতিতে বিরাজমান সব রং দিয়েই হয় রংধনু।  ইতিহাসের কোনটাই পরষ্পরের বিচ্ছিন্ন নয়। পরষ্পরের সাথে সংশ্লিষ্ট ও অবিভাজ্য।

প্রকৃতির সব ফুলই পূষ্প। আর, তা প্রয়োজনীয় ও বটে কোন না কোনভাবে।  সুতরাং, প্রকৃতি ও পৃথিবীর সব ফুল নিয়েই গড়া হোক পৃথিবী।