“আশা রাখি পেয়ে যাব বাকী দু’আনা “

এপ্রি ২৪, ২০২৩

সম্ভবতঃ ১৯৯১ সন। সন্ধ্যা নেমে এসেছে । কোন একটি এলাকায় সাংগঠনিক সফর শেষ করে হাঁটছিলাম । আগ্রাবাদ চৌমুহনী মোড়। তখন এ রাস্তা প্রস্থে আরো সরু ছিল । মাঝে ছিল সড়ক দ্বীপ। হঠাৎ আমার কাঁধে নেমে এল একটি হাত। সাধারণত তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটতেন না। আমি আড় চোখে বোঝার চেষ্টা করছি। কী হল ? তিনি আমার নেতা ছিলেন । ক্রমশঃ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। বড় ভাইও হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর গলা ভারী হয়ে এসেছিল । শান্ত, ধীর কন্ঠে তিনি বলে চললেন । “যে সরল চিন্তা নিয়ে , সাধারণ বুঝ নিয়ে, আর গোটা দুনিয়ায় এতদিনের রাজনৈতিক মানচিত্র দিয়ে আমরা এবং আমাদের জন্মেরও আগের প্রজন্ম রাজনীতি করে এসেছি। সে দর্শনকে শ্রেষ্ঠত্ব ,মহত্ব ও যোগ্যতার প্রশ্নে এত কঠিন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি আগে কখনো। আমরা এবং আমাদের উত্তর প্রজন্ম যারা আগামী দশকে বা শতকে রাজনীতি করবে তাদের একটি কঠিন দার্শনিক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। রাজনীতি আর আগের মত থাকছেনা।” তখনো আমাদের ঘোর দশা। মতাদর্শিক হ্যাং ওভার চলছে। আকস্মিক সোভিয়েত এর পতনে , বার্লিন ওয়ালের ধ্বসে পড়ায়, চসেস্কু হত্য, লেনিনের মূর্তি অপসারণের তাণ্ডবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! কেউ কেউ তখনো জপমালার মত জপে চলেছেন, তত্ব সঠিক – প্রয়োগ ভুল। আমার কাঁধে হাত রাখা তরুণ বয়সে আমার চেয়ে ঢের বড় নয়। তবে চিন্তায় অগ্রসর ছিলেন সমকালে । অনেকের চেয়ে অনেক বেশী কৌতূহলী ছিলেন । তত্ত্বের নিরেট বালিতে মুখ গুঁজে থাকা মানুষ ছিলেন না। যা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর প্রতি শতভাগ নিষ্ঠ ছিলেন ।

তিনি যখন সবে অনার্স পড়ছেন। প্রথম বর্ষের ছাত্র । সে বয়সে একদিন ছাত্র ইউনিয়নের নবীন সদস্যদের পড়াচ্ছেন । আমি কোন এক পতঙ্গের মত গিয়ে সে ক্লাসে হাজির হয়েছিলাম । কারেন্ট বুক সেন্টারে একখানি হাতে লেখা পোস্টার দেখেছিলাম । পরে জেনেছিলাম সুন্দর হাতে লেখা সে পোস্টার লিখেছেন Motahar Husen বাদল ভাই। পাশেই দারুল ফজল মার্কেট । তাতে ঠিক সেসময় রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ক্লাস চলছে। গুটি গুটি পায়ে আমি হাজির হলাম। ছিপছিপে গড়নের এক তরুণ ক্লাস নিচ্ছেন “সমাজতন্ত্র মুক্তির অলঙঘনীয় পথ”। সেই ক্লাসে যুক্তি ও বুদ্ধির ছিপে আমি আটকে পড়া মাছ। আমার গন্তব্য স্থির হয়ে গেল। তারপর চেনা ইতিহাস । আশির দশকের সেই পথ।

সেই তরুণ এর কণ্ঠে ১৯৯১ এর এক সন্ধ্যায় সংশয়- অনিশ্চিত গন্তব্য – খানিকটা দ্বিধা। যেন শুনে চমকে উঠলাম । সে দিনগুলোর পরেই এলো ভাঙাগড়ার ডামাডোলের সময়। ক্রমশঃ নতুন দশক এলো । নতুন সহস্রাব্দ এলো। চৌমুহনী মোড় থেকে ধীর পায়ে আমরা শেখ মুজিব সড়ক ধরে হেঁটে গেছি আরো বেশ। তিনি বলে চললেন, আগামী দশকে এই সড়ক হয়ত আরো প্রশস্ত হবে। আগামী শতাব্দীর তরুণেরা নির্ভীক চিত্তে তাদের প্রেয়সী তরুণীর কাঁধে ভরসার হাত রেখে নিঃসংশয়ে হেঁটে যাবে। ত্রস্ত চিত্তে নয়। কিন্তু, চিন্তা ও দর্শনের জগতে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে তাকে মোকাবিলা না করে সেই প্রশস্ত সড়কের যাত্রী হওয়া যাবেনা।

আজ তিন দশক হতে চলল। পৃথিবীর চেনা চিত্র পাল্টে গেছে আমূল। কত কত ভাষণ শুনি। কত শত আহ্বান শুনি। স্বপ্ন দেখিনা। ভাষণ আর কথায় সেই বিভা দেখিনা। আলোকচ্ছ্বটা দেখিনা। চর্বিত চর্বণ দেখি। গাঙে আর ভরা জোয়ার আসেনা। লেফট – রাইট দেখি। মার্ক টাইম দেখি। মার্চ পাস্ট দেখিনা। যে চ্যালেঞ্জ এর মুখে দাঁড়িয়েছিল মুক্তি আন্দোলন , তাকে মোকাবিলা করছে ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। ফলে অগ্রগতির সংবাদ নেই। যদিও মানুষের লড়াই ছড়িয়েছে বহু মাত্রিকতায়। লড়াইয়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে ।

আমার বন্ধু- নেতা – ভাই আজো আছেন । মিছিল এর পুরনো মুখ হয়ে নয়। মিছিল এর নয়া দিশা খুঁজে বেড়ান। পথ থেকে পথে । হেথা নয় হোথা। আজো পুরনো মিছিল ছোট হলে , কিংবা পুরনো মিছিল এর মানুষের ব্যথায় তিনি কাঁদেন। তিনি আসলে তিনি নন , আমাদের প্রজন্ম । আমাদের সমর্পিত হয়ে ও সমর্পণের যৌক্তিকতায় আস্থা হারানোর কষ্ট । এ বেদনার। এ যন্ত্রণার । তবুও, আশা রাখেন তিনি। পথ খুঁজেন । তিনি যদ্যপি আমার গুরু Masud Rahman। আশা রাখিতে যাই আমরাও।

“কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে
ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা।
অনেক দিনের পর মিলে যাবে অবসর
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা।

আশা নিয়ে ঘর করি, আশায় পকেট ভরি
পড়ে গেছে কোন ফাঁকে চেনা আধুলি-
হিসেব মেলানো ভার আয় ব্যয় একাকার
চলে গেল সারাদিন এলো গোধূলি
সন্ধ্যে নেবে লুটে অনেকটা চেটেপুটে
অন্ধকারের তবু আছে সীমানা
সীমানা পেরোতে চাই জীবনের গান গাই
আশা রাখি পেয়ে যাব বাকি দু’আনা… “