মুক্তিপরায়ণ সমাজের খোঁজে: স্পার্টাকাস থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
June 3, 2020 | 1:02 pm
পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ, বীরোচিত মৃত্যু মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এক বিশাল মাইল ফলক। দাসবৃত্তির জীবন ছুঁড়ে ফেলে মনুষ্যোচিত জীবনের খোঁজে খ্রিস্টিয় শতকের শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী শতকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন শক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্যকে। তার আগে অচিন্ত্যনীয় বিদ্রোহ শুরু হবার পর তাতে শামিল হয়েছিলেন ৭০, হাজারের বেশি দাস। বীরোচিত লড়াইয়ে তিনি জীবন দিয়েছিলেন। আর বেঁচে যাওয়া ৬ হাজার দাসকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। দুই সহস্র বছর আগে স্পার্টাকাস যে লড়াই শুরু করেছিলেন, অভ্যস্ত জীবনের ছন্দে সুর মেলালে তা তিনি করতে পারতেন না। দাসবৃত্তির জীবন ছুঁড়ে ফেলে মনুষ্যোচিত জীবনের সন্ধানে তিনি বিসর্জন দিয়েছিলেন নিজের প্রাণটাই।
মনুষ্যোচিত জীবনের জন্য মানুষের সাধনা নানা পথে এগিয়েছে। পরম আরাধ্য পরমের খোঁজে, জাগতিক দুঃখ-কষ্ট ও নিপীড়ন-বঞ্চনা থেকে মুক্তির আঁশে মানুষের সাধনা। মানুষের চেষ্টা। চেনা জগতের চেনা হরফ, চেনা জগতের চেনা বিশ্বাস, চেনা জগতের কাঙ্ক্ষিত ও আরাধ্য পথের বাইরে সত্য ও মুক্তি বা মুক্তির সত্য যখনই খুঁজেছে মানুষ, সে বা তারা হয়ে উঠেছেন হুমকি। কখনো হত্যা, কখনো নিপীড়ন ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ পুরস্কার অথবা তিরস্কার।
মুক্তির আশায়, মুক্তি লভে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা জনপদ নির্বিশেষে চিরন্তন। মুক্তি পথের দিশারী যারা, জানা ইতিহাসের বাঁকে সন্ধান খুঁজেছেন। নিদান পেতে চেয়েছেন। শেষ অবধি নিদান বার করেছেন নিজেরাই। আলবেরুনী থেকে গ্যালিলিও, ব্রুনো থেকে আর্কিমিডিস, ঈশ্বর পুত্র যিশু থেকে নবি মুহাম্মদ (সঃ), শ্রী চৈতন্য থেকে লালন। কেউই ব্যতিক্রম নয়। কী খুঁজেছিলেন তারা। যা খুঁজেছেন, এক কথায় যদি বলি- তা হল মুক্তি। সর্বপ্রকার শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন থেকে মুক্তি, যাপিত জীবনের অজস্র গ্লানি থেকে মুক্তি, সর্বোপরি শান্তি। সুখ। জীবনের পরম প্রার্থিত।
না, কোন পূর্ব পুরুষের শান বাঁধানো ঘাটের জলে ডুব দিয়ে তারা মুক্তির কলস খুঁজে বেড়াননি। প্রতিটি যুগে, প্রতিটি কালের নিজস্ব রুপ আছে। আছে জঞ্জাল। আছে কষ্ট। আছে দুঃখ ও সংকট। তেমনি থাকে পরিত্রাণের অনন্য ও সৃজনশীল পথ। পথে হাঁটতে হাঁটতে পথিক সে পথের সন্ধান করে, একই সঙ্গে সে পথ রচনা করে। ভাণ্ডারে থাকা অভিজ্ঞতা, পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া দাগ, সে পথের বাধা মোকাবেলায় তাকে প্রণোদনা দেয়।
পৃথিবীতে পুঁজির পোয়াবারোর কাল চার শতকের বেশি হতে চললো। অনন্ত মুক্তির অভিযাত্রায় মানুষের আবিষ্কার, মানুষের শ্রম, পণ্যের মূল্যে যে অপরূপ মূল্য যুক্ত করে, তাইই সচল রাখে পুঁজির চাকা। পুঁজির প্রাণ ভোমরা তাই মানুষের ঘামে ভেজা শ্রম কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম। পুঁজির মালিকের শরীরে সে যুক্ত করে অজস্র পালক। সে উড়াল দেয় ভূমি ছাড়িয়ে মহাকাশে। জমির নীচে, জমির উপরে, আকাশে, আকাশ ছাড়িয়ে সে রচনা করে পুঁজির অনবদ্য জয়যাত্রা। মানুষের শ্রমশক্তি নিংড়ে পুঁজির জয়যাত্রার ডিএনএ ঠিক বার করে নেন অদম্য মার্কস।
পুঁজির আদিম সঞ্চয়ের যুগ ধরে, ক্রমাগত পুঁজির বিশ্বজুড়ে বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা যখন সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে, সে যুগে আগের সব ইতিহাস ছাড়িয়ে তিনি দ্রষ্টার ভূমিকা নিয়ে বলে উঠলেন, পুঁজির গোরখোদক হলেন স্বয়ং তার নির্মাতারা। তিনি আধুনিক সর্বহারার কাঁধে ভর দিয়ে নয়া জমানার নয়া ইশতেহার লিখলেন। ভরসা রাখলেন সর্বহারার পেশিতে ও সংখ্যায়। কিন্তু আশ্রয় নিলেন পুঁজিতন্ত্র সৃষ্ট রাষ্ট্রের উপর। আশা রাখলেন, একদল বিপ্লববাদী যারা শ্রমজীবীদের অধিকার রচনায় পুরনো রাষ্ট্র যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, পুরনো শাসকদের হটিয়ে দেবেন। সে সময় অবধি বিকশিত ইংল্যান্ডের অর্থনীতি, জার্মান দর্শন আর ফরাসী সমাজতন্ত্র ছিল তার চিন্তার উৎস। তিনি তার আমৃত্যু সহযোগি এঙ্গেলসসহ গঠন করলেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক। যা ছিল আদতে একটি ফেডারেশন।
প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট বামপন্থীরা যারা এখানে যুক্ত হয়েছিলেন, কথা ছিল তারা রক্ষা করবেন ঐক্য ও সংহতি। পরস্পর স্বাধীন থেকে সম্মিলিতভাবে তারা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন, পুঁজিতন্ত্রের জোয়াল ভাঙার কর্মসূচি। চিন্তার বিবিধ স্রোতে, স্বাধীনতাকামীদের তরফে প্রশ্ন ওঠে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা আসে। পুঁজি রাষ্ট্রের অর্গল ভেঙে নয়া রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চ্যালেঞ্জ আসে। প্রথম আন্তর্জাতিকের ভেতর থেকেই বাকুনিন জোরালো কন্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। সুনির্দিষ্টভাবে তিনি বলেন , “আমাদের মধ্যে সবচাইতে বড় বিপ্লবীকে আপনি রাশিয়ায় জারের ক্ষমতায় বসিয়ে দেন, সেই বিপ্লবী লোকটি এক বছর যাওয়ার আগেই জারের চাইতে বড় জারে পরিণত হবেন।”
হাজার বছরের ইতিহাসজুড়ে চালিত রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান-যাজক-কর্তা-কর্তৃত্ব-সম্পর্কের পুরনো জগতের নিয়ম ও শৃঙ্খল ভেঙে আধুনিক পুঁজির সম্ভাব্য গোর খোদকদের নামে জারীতব্য নতুন রাষ্ট্রেও পুরনো শাসকের স্থলে নয়া শাসক, পুরনো রাষ্ট্রের নিপীড়কের স্থলে নয়া নিপীড়কের আসন্ন উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে যারা উৎকণ্ঠিত ছিলেন তারাও পুঁজির নির্মম শোষণ-নিপীড়নের বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্রের পরিবর্তে নয়া রাষ্ট্রে ছিল না তাদের আস্থা। আজ থেকে ১৫০ বছর আগে যে সংশয় বাকুনিন ব্যক্ত করেছেন তা যেন হয়ে উঠেছে প্রোফেটিক সত্য। বাকুনিনের জোরালো কন্ঠস্বরের মাত্র চার দশক পরে সাধিত বলশেভিক বিপ্লব এবং তার পরিণতি নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
উনিশ এবং বিশ শতকে দুনিয়া মার্কসের প্রস্তাবিত ও কল্পিত সড়কে না হাঁটলেও, মার্কসবাদী হিসেবে যারা হাজির ছিলেন তারা, তাদের মতাদর্শ সমগ্র দুনিয়াতে একটি অতি প্রভাবশালী মতাদর্শ হিসেবে মানুষের কাছে ধরা দিয়েছে। বিগত শতকের শেষ দশক শুরু হওয়ার সময়ে এই মতাদর্শ সামগ্রিকভাবে জগতজোড়া হারিয়েছে গ্রহণযোগ্যতা। অথচ, এই মতাদর্শের সমান বা অধিক বয়সী ‘অপর যে মুক্তি চিন্তা বিরাজ করেছে, তা নেতৃস্থানীয় হয়ে ওঠেনি। চিন্তার এই স্রোতে যারা ভেসেছেন, তারা কেউ নিজেদের নৈরাজ্যবাদী, কেউ অরাজপন্থী, কেউ মুক্তি পরায়ণ সমাজতন্ত্রী এরূপ বিভিন্ন নামে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত প্রুঁধো’র “What is Property” শীর্ষক গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করেন মার্কস। অনেক চিঠিপত্র ও তিনি আদান প্রদান করেন প্রুঁধো’র সাথে। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কে ছেদ ঘটে যখন প্রুঁধো’র রচিত “The Philosophy of Poverty” গ্রন্থের সমালোচনা করে মার্কস লিখেন “Poverty of Philosophy”। এই দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে মুক্তি চিন্তকেরা প্রুঁধোকে নৈরাজ্য দর্শনের নবী হিসেবে ও মাার্কসকে সাম্যবাদী চিন্তার নবী হিসেবে স্থাপন করে। কিন্তু মার্কসবাদী চিন্তাশীলদের মধ্যে মার্কস যেরূপ আদি ও অনতিক্রম্য চিন্তার ভারী পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন বা ছিলেন, প্রুঁধো নৈরাজ্য চিন্তার অনুগামীদের মধ্যে সেভাবে অনুসৃত হননি। নৈরাজ্য চিন্তা অর্গল খুলে ছুটেছে অজস্র ডানা মেলে।
পুঁজির এক মেরু বিশ্বে হাঁসফাঁস করে ওঠা মানুষের জন্য, মুক্তি চিন্তার মানুষের জন্য তাই বরাবরই মার্কসের চিন্তা ও দর্শনের পাশে নৈরাজ্য চিন্তা নানাভাবে ভাবনা ও কাজের উৎস হয়ে আছে। বিশ্বব্যাপি ফলিত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে সাফল্য ও ব্যর্থতা মার্কসবাদীদের। কিন্তু মার্কসবাদী চিন্তা ও দর্শনের যে সীমাবদ্ধতা গত দেড়শ বছর ধরেই নৈরাজ্য চিন্তার বিভিন্ন অনুসারীরা বলতে চেয়েছেন তা আলোচনা ও বিবেচনার দাবি রাখে।
নৈরাজ্য চিন্তকেরা দাবি করেন, নৈরাজ্য চিন্তার মূলে রয়েছে মানুষের স্বাধীনতার চিন্তা। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে আহরণ করে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে সিরিয়াস সিদ্ধান্তে পৌঁছানো দুঃসাধ্য, এটি মেনেই নোম চমস্কি বলেন, “স্বাধীনতার জন্য মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি আছে।”
সুতরাং, অজস্র মানুষের উপর একদল ক্ষুদ্র, মহত ও কল্যাণপিপাসু মানুষের নিজস্ব কল্যাণ চিন্তার প্রয়োগ জবরদস্তি। যা মানুষের স্বাধীনতার চিন্তার অন্তরায়। নৈরাজ্যচিন্তা কেন্দ্রীভূত, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও কাঠামোকে নাকচ করে। রাষ্ট্র ও তার ডালপালা ছাটতে চায়। নিপীড়ক হিসেবে গণ্য করে রাষ্ট্র যন্ত্রপাতিকে প্রতিস্থাপিত করতে চায় ক্ষুদ্র-বিকেন্দ্রীকৃত সমবায় দিয়ে। যার লক্ষ্য এবং উদ্দিষ্ট কর্তা হল ব্যক্তি নিজে। স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতা নিয়ে ব্যক্তির যৌথতা সে নাকচ করে না। কিন্তু ব্যক্তির কল্যাণের নামে সমষ্টির উপর ব্যক্তির কর্তৃত্ব স্বাভাবিক স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে নৈরাজ্যচিন্তা মনে করে।
মার্কসবাদীরা যেকোনভাবে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে যেখানে নিশ্চিত করতে চায়, উৎপাদিকা শক্তির উপর সামাজিক মালিকানার নামে কার্যত রাষ্ট্রের মালিকানা। নৈরাজ্য চিন্তকেরা মনে করেন, আমলাতন্ত্র পরিচালিত রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রকৃতপক্ষে নিশ্চিত করে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদকের স্থায়ী বিচ্ছিন্নতা। উৎপাদনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে তাদের পছন্দ যৌথ মালিকানা। কিন্তু মালিকানা প্রশ্নে পুঁজিবাদী সমাজে বিদ্যমান ব্যক্তি মালিকানা থেকে এই যৌথ মালিকানার পার্থক্য বোধ হয় খুব বেশি নয়।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব থেকে অক্টোবর অবধি রাশিয়ায়, ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ অবধি স্পেনের কাতালোনিয়ায় নৈরাজ্যচিন্তকদের এই প্রস্তাবনা এক ঝলক দেখার সুযোগ হয়েছিল। রুশ বিপ্লবের পর লেনিন ডিক্রি জারি করে বাতিল করেন সকল সোভিয়েত। কার্যত যা ছিল কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের সমবায়। যারা পরিচালনা করছিলেন কারখানাগুলোকে। বদলে তিনি এবং তার উত্তরসূরিরা গড়ে তুলতে চেয়েছিলন শ্রমজীবী শ্রেণীর শক্তিশালী রাষ্ট্র। পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের ঐতিহাসিক কালপর্বে তথা সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে অপরিহার্য বলে রাষ্ট্রের শক্তি ক্রমাগত বাড়িয়ে গেছেন। মার্কসবাদী লেনিনসহ তার উত্তরসূরিরা যাকে বলেছেন, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব।
নৈরাজ্য পন্থীদের কঠোর সমালোচনা হলো, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কার্যত ক্রমাগত হয়ে উঠেছে দলের একনায়কত্ব, দল থেকে তা দলের পলিটব্যুরো, সবশেষে গিয়ে তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদকের হাতে। যে মতাদর্শ দাবী করে নিজেকে একটি বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ হিসেবে, বাস্তবতার পরীক্ষায় তা নির্বিশেষে ফলাফল দিয়েছে অভিন্ন। বহু মত-পথ-বৈচিত্র্যকে নির্মূল করে, যে মার্কসীয় মতাদর্শ জয়ঢঙ্কা উড়িয়ে গেছে সাত দশক, শেষ অবধি তা ফেটে চৌচির হয়েছে। যে’কটি দেশে উড়ছে সেই পতাকা, তা উৎপাদনের পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে নিরেট পুঁজিতান্ত্রিক পথ। বিপরীতে, নৈরাজ্য চিন্তা বহু মত-পথের অজস্র পত্র পুষ্পে বিকশিত করতে চায় মানুষের বিকাশের জানা অজানা পথ।
নৈরাজ্য আস্থা রাখে, “ঐতিহাসিক দিক থেকে, সবচেয়ে চালাক একটি কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্রান্ততার তুলনায় সত্যিকারের একটা বৈপ্লবিক আন্দোলনের করা ভুলভ্রান্তি সীমাহীন রকমের অধিক কাজের (রোজা লুক্সেমবার্গ)।” অনেকটা তা মহাত্মা গান্ধীর ধ্বনিতে যেমন শোনা যায় তার কাছাকাছি “আমি চাই ভুল করবার স্বাধীনতা, এবং ভুল শুধরানোর স্বাধীনতা, এবং নিজের পূর্ণ উচ্চতায় নিজেকে বিকশিত করার স্বাধীনতা, এবং হোঁচট খাওয়ার স্বাধীনতাও। ভর করে হাঁটার জন্য ক্র্যাচ চাই না আমি।” নৈরাজ্য আস্থা রাখে মানুষের মধ্যে মৈত্রী-সহযোগিতা-আস্থার উপর।
নৈরাজ্য চিন্তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় Nestor Ivanovych Makhno’কে। ইউক্রেনে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নৈরাজ্য চিন্তায় উন্নয়নের একটি ধারা। যিনি বলশেভিকদের বিবেচনা করেছিলেন তাঁর জন্য হুমকি হিসেবে। যদিও শ্বেত বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি লাল ফৌজের সাথে যুদ্ধ জোট গড়েছিলেন। অনেক প্রবাদ প্রতিম জনযুদ্ধের মাধ্যমে লড়েছেন শ্বেত বাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু ১৯২০ সালে শ্বেত বাহিনীর পরাজয়ের পর লাল ফৌজ সমর সজ্জিত হয় Makhno নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে। লাল ফৌজের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে তিনি পালিয়ে যান প্যারিসে। ১৯২৬ সালে গঠিত হয় Platform নামে নৈরাজ্য চিন্তার মানুষের একটি সাধারণ জোট। ১৯৩৪ সনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত Makhno তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তি পরায়ণ সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে Platform’কে বিবেচনা করা হয় নৈরাজ্য চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে।
নৈরাজ্য চিন্তা প্রধানত তোপ দাগে কর্তৃত্ববাদী চিন্তা, ধারণা, সংগঠন ও একনায়কতন্ত্রের উপর। ভরসা রাখে বরাবর বিকেন্দ্রীকৃত চিন্তা, ধারণা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তি সমষ্টি তথা গ্রুপ এবং এই সকল ব্যক্তি-গ্রুপ-সমবায়ের সমবেত চিন্তার বৈচিত্র্যময় প্রকাশের উপর। ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো নৈরাজ্য চিন্তা নানাভাবে আছড়ে পড়েছে নানান রূপে, নানান আঙ্গিকে, নতুন মাত্রায় বিবিধভাবে। ১৯৬৮ সালের প্যারিস বসন্ত ইউরোপ-আমেরিকা-লাতিন আমেরিকা হয়ে প্রাচ্যের দেশে দেশে চিন্তার জগতে প্রবল ঝড় তুলেছে স্বাধীনতা চিন্তায়। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা পুরনো ও অচল চিন্তাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে। ২০০৪ সালের সিয়াটলে বিশ্বায়ন বিরোধী বিক্ষোভের তরঙ্গে, ৯৯ শতাংশের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে ১ শতাংশের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টে, আরব বসন্তের বজ্রপাতে নৈরাজ্য চিন্তা পাখা মেলেছে।
একুশ শতকে নৈরাজ্য চিন্তার চাঞ্চল্যকর আবির্ভাব ঘটেছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের নেতৃত্বে। লক্ষ লক্ষ ক্লাসিফাইড দলিলাদি জনসন্মুখে ফাঁস করে দিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে মার্কিনসহ বহু দেশের জনস্বার্থ বিরোধী শাসক গোষ্ঠী ও বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলোকে। মার্কিন শাসক ও তাদের সহযোগীদের কাছে অ্যাসাঞ্জ তাই হয়ে উঠেছেন মূর্তিমান আতঙ্ক। তথ্যের অধিকার ও তথ্যের প্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার এবং মানুষের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্রগতি। নৈরাজ্য চিন্তার লড়াই তাকে সামনে এনেছে প্রবলভাবে।
“ক্রিপ্টো এনার্কিজম” একুশ শতকের এনার্কির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান সমূহের নাক গলানো নতুন কিছু নয়। ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে রাষ্ট্রের খবরদারি ও বিকিকিনি, ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ক্রিপ্টো এনার্কিজম ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিকল্প কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান নিশ্চিত করতে চায়। ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস-রুচি-চিন্তা-অর্থনৈতিক আচরণ ও স্বাধীনতাকে রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গোপন রাখা তার অধিকার। ব্যক্তির জীবনাচরণ ও অভ্যাস কর্পোরেটের মুনাফার জন্য নৈরাজ্য তুলে দিতে নারাজ। এর মধ্য দিয়েও সে কার্যত নিশ্চিত করতে চায় স্বাধীনতা। নিজের মতো নিজের বাঁচার স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের প্রতি তার গভীর সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মধ্য দিয়েই উঠে আসে। ডিজিটাল মুদ্রার নিরাপদ ও বিকল্প ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যবহারকারী নিজের পরিচয় উহ্য রেখে কিংবা ভিন্ন নামে লেনদেন করে, রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। যা আখেরে, রাষ্ট্রের প্রচলিত কর ব্যবস্থা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক আচরণ ও নিয়মের উপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে কঠিনতর করে তুলতে পারে বলে নৈরাজ্য মনে করে। যদিও অজস্র কালো অর্থনীতির কালো টাকা ও এই ফাঁকে নিজেকে হাপিস করে দেয়ার সম্ভাবনা অমূলক নয়। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ যে রাষ্ট্র এবং যা টিকে থাকে ভয়-জবরদস্তি-শোষণ-লুণ্ঠন-কারাগার-শাস্তি-নিপীড়নের উপর, তাকে নাকচ করার মধ্যে, তথা নেতির নেতিকরণের মধ্যে নৈরাজ্য নাকচ করে নিজের তন্ত্রকেও তথা নৈরাজ্যবাদকেও। নৈরাজ্য চিন্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পিয়েরে জোসেফ প্রুঁধো যেমন বলেন ,”নৈরাজ্য হচ্ছে ক্ষমতা বাদ দিয়ে অর্জিত নিয়ম-বন্দোবস্ত” (“অ্যানার্কি ইজ অর্ডার উইদাউট পাওয়ার”)।
চারশত বছরের পুঁজিবাদ তার চরম উৎকর্ষের সময়ে সম্পদের অস্বাভাবিক ও চরম কেন্দ্রীভবন তৈরী করেছে। জন্ম দিয়েছে চরমতম বৈষম্য। ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছাপিয়ে এ গ্রহের সকল মানুষের পৌঁছে যাওয়ার কথা প্রাচুর্যে। অথচ তা গুটিকতকের হাতে। এই বিপুল বৈষম্য পীড়িত সময়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে অনুরুপভাবে। জন্ম নিয়েছে কতিপয়তন্ত্রের। ক্রিপটো এনার্কি পুঁজির একচেটিয়া খর্ব করতে চায় যে অস্ত্রে, সেই অস্ত্র কখনো কী গোটা দুনিয়াকে কতিপয় অতি বুদ্ধির মানুষের কাছে জিম্মায় নিতে পারে? সেই সম্ভাবনা কী উড়িয়ে দেয়া যায়?
উৎপাদন সম্পর্কের বিচারে নৈরাজ্য চিন্তা যেহেতু ব্যক্তিগত মালিকানাকে নাকচ করে না, সেহেতু ক্ষুদ্র ব্যক্তি মালিকানার সমবায়, বৃহৎ পুঁজি হয়ে উঠবে না, একথা নিশ্চিত বলা মুশকিল। তদুপরি তীব্র বৈষম্যকে কী করে রোধ করতে হবে, সে বিষয়েও বোধ হয় নৈরাজ্য চিন্তার মধ্যে সন্ধান মেলে না।
আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ তার অনবদ্য ভাষায় বলেছিলেন, “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।” এ যাবতকালের দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে নৈরাজ্য চিন্তা প্রধানত আস্থা রাখতে চেয়েছে, মানুষের অপার সম্ভাবনা ও ক্ষমতায়। ব্যক্তিকে সমষ্টির অধীন নয়, সমষ্টির নামে কিছু ব্যক্তির যন্ত্রে রূপান্তরের কারবারে নৈরাজ্যের অনাস্থা তীব্র। সুতরাং রাষ্ট্রের উপরে তার সঙ্গত অবিশ্বাস সত্বেও সে চায়, ব্যক্তি মানুষের ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র চাওয়ার সামষ্টিক আত্মপ্রকাশে সে শুধু জ্বালানি হবে না, হবে নির্মাতা। ইতিহাসের অবজেক্ট থেকে মানুষ হয়ে উঠুক সাবজেক্ট। “কর্তার ইচ্ছায় কর্ম” হয়ে ওঠা নয়, মানুষকে কর্তার সত্বার মধ্যে দেখা তার বাসনা। কারণ স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা সবসময়। অন্যকিছু নয়। কখন মানুষের সমবেত ইচ্ছা মূর্ত হয়ে উঠবে এবং আমরা গাইতে পারব সেই গান Liberte, liberte, toujour la (স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা চিরদিন)।
স্পার্টাকার্স থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, মানুষের আরাধ্য একটিই, মুক্তি-মুক্তি-মুক্তি। নৈরাজ্য চিন্তা বা স্বাধীনতা চিন্তা বা অরাজ চিন্তা মুক্তির সে দিগন্তরেখার আভাষ দেয়।