“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব–
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।”
শৈশব কৈশোরে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ড্রইং ক্লাস ছিল । বাধ্য হয়েই কিছু আঁকতে হত । হাতের লেখা যেমন ছিল বিচ্ছিরি , তেমনি ড্রইংও ছিল তথৈবচ । সমবয়েসীদের আঁকা সুন্দর সব ছবি বিষ্ময় জাগাত । মুগ্ধতা ছড়াত মনে । আর যারা সেইসব ছবি এঁকে ফেলত অনায়াসে , তাদের প্রতি ঈর্ষা বোধ তৈরী হত । মনে হত পরীক্ষায় ফার্স্ট/সেকেন্ড হওয়া যায় , এমন ছবি আঁকা যায় না ।
প্রায় সব শিশুর যেমন ভাল লাগে খেলতে , আমারো তেমনি ভীষণ প্রিয় ছিল খেলাটা । আজো মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি । ক্লাস নাইন ছাড়িয়ে , ক্লাস টেনে ওঠার পরও আমি স্কুলে যাবার সময় বয়ে নিয়ে যেতাম ভারী একখানা ক্রিকেট ব্যাট আর কাঠের বল । খেলতাম সবাই। সেই বাসে চেপে , কখনো তিন মাইল পায়ে হেঁটে কিংবা রিক্সায় চেপে, শীত – গ্রীষ্ম ব্যাটটা ঠিক বয়ে যেতাম । মোটেও ভাল খেলতাম না । অনেকেই ভীষণ ভাল খেলতো । তবুও ব্যাটটা বয়ে না নিলে যেহেতু খেলাটাই হবেনা , মজাটাই পাব না , সুতরাং পারি কি না পারি খেলতে , ব্যাট বয়েই নিতাম ।
বাংলা একাডেমী’র এক টাকার ‘শিশু’ – দু’টাকার ‘নবারুন’ আর পাঁচ টাকার ‘ক্রীড়াজগত’ পড়ছি । তাতেই বরং অপেক্ষাকৃত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি । মাঠ ভাল লাগে । ভাল লাগে খেলতে । অথচ আমি তা পারিনা । খেলোয়াড় হয়ে ওঠা হলোনা । মার্শাল – গার্নার – গাভাস্কার দেখতে বা শুনতে ভাল লাগে । কারাতে – কুংফু ভাল লাগে । ব্রুস লি ভাল লাগে । ভাল লাগে বাংলা ছবি দেখতে । সদ্য আসা ভিসিআর এ হিন্দি ছবি ভাল লাগে । বাবা’র চোখ ফাঁকি দিয়ে , মা’কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে টারজান ভাল লাগে । নাইট রাইডার মন টানে । চলছিল দিন এভাবেই।
স্কুলে যাবার রিক্সা ভাড়াটা বাঁচিয়ে দস্যু বনহুর – কুয়াশা – মাসুদ রানা – তিন গোয়েন্দা – ওয়েষ্টার্ণ ক্লাসিকস পাড়ি দিয়ে ছোটদের রাজনীতি – অর্থনীতি- যে গল্পের শেষ নেই এ যখন ভীড়তে শুরু করেছি , হঠাৎ যেন চেনা শৈশব কৈশোর থেকে ঝটিতে চলে এলাম অন্য জগতে । বিকেলটা এক পলকে শেষ হয়ে সাঁঝ নেমে এল ।
পৃথিবীর পথে – পৃথিবীর পাঠশালায় যখন দীক্ষা নিচ্ছি , প্রগতি প্রকাশনের প্রকাশনা গলাধঃকরণ করছি , শামসুর রাহমান বুকের গভীর থেকে বনপোড়া হরিণীর আর্তনাদে কেঁদে উঠছেন , কামরুল হাসান যখন বিশ্ববেহায়াকে চিত্রিত করছেন , তখন হঠাৎ করেই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়তে শুরু করেছে বার্লিন প্রাচীর । সাবেক সোভিয়েত টুকরো টুকরো হতে শুরু করেছে । বয়োঃবৃদ্ধির পূর্বেই আমরা বয়ষ্ক উঠি । ডানা মেলার আগেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ভিজে উঠতে থাকে । আমরা আর্দ্র হয়ে উঠি । আমি থেকে আমরা হয়েও আমাদের আমিত্বগুলো পৃথক হতে থাকে । আমরা মেতে উঠি আপন প্রাণের খোঁজে ।
বিশ্বাসের ভরসা থাকে । অবিশ্বাসের থাকে ঔদ্ধত্য। ঘাড় গুঁজে দিয়ে স্তোত্র বাক্যে সমর্পণের স্বস্তি থাকে । ঋজু হয়ে থাকতে গেলে জ্বালা বাড়ে । যে জ্বালায় জ্বলে পোড়ে ভেতর বাহির ।
এক প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আমার । দাবা খেলতেন আমার সাথে । তিনি প্রিয় হয়ে ওঠার আগে তাঁর আড়মোড়া ভাঙতেন আমার পিঠে । একদিন – দুদিন যায় । আমার পিঠ আর সয়না । একদিন ছুঁড়ে মারি কলম। এক লাফে পড়ার টেবিল ছেড়ে পালাই । পরদিন বাধ্য হয়ে ফিরে আসি । বেদম পিটুনি খাই । তারপর তাঁর আড়মোড়া আর হাই তোলা থেকে আমার পিঠ চিরতরে রেহাই পায় । তিনি ক্রমশঃ আমাকে জয় করেন । কিংবা কোন এক না জানা রসায়নে । অভব্য আমি তাঁর অবসরের দাবার সঙ্গী হই । মাথা না নোয়ানোর , জাত গোয়ার্তুমী কি জন্ম থেকেই ছিল আমার ?
‘কি করিতে হইবে ‘ পড়ে আসলে কিছু করা হয়নি । কিছু করতে করতে , ঠেকে ঠেকে , ভুলে ভুলে জানা হয়েছে কি করা উচিত ছিল । জানা যখন হয়েছে , তখন তো হয়েই গেছে । ঠিক ঠিক যা করতে চেয়েছি , তাইই কি করা হয় সকলের ? জীবনের মধ্যাকাশে এসে যখন , জীবনের বাঁকগুলোকে দেখি , সরল বলে সোজা হেঁটে আসা পথের মাঝে না দেখা কত যে মোচড় , হাঁটবার আগে জানা ছিল কি ?
যে পথে যাইনি হেঁটে , অচেনা সেই পথে সংশয়হীন হেঁটে গেছি জ্যেষ্ঠের হাত ধরে । হেঁটে হেঁটে মাড়িয়েছি পাঁক । সদর রাস্তায় উঠেছি । অমৃতের সন্ধান মিলেছে । মিলেছে গালিব । মান্টোর বিষণ্ণ বিদায়ের শংকায় ডুবেছে । রংধনু সাত রং মেলেছে পাখা । মেঘে মেঘে কালো হয়েছে আকাশ। পাঁকে আটকে গেছি । পথ হারিয়েছি । বিঁধেছে কাঁটা । না বলা অজস্র কথার তুবড়ি ছুটেছে ।
তবুও , যায়না মুগ্ধতা । মুগ্ধতার ছবি মনে মনে আঁকা । পারিনি যা করতে । চেয়েছি যদিও সহস্রবার । ভুল হয়েছে । আবারো ভুল । পথের খোঁজে পথ হাঁটতে চেয়েছি । থামিনি এখনো। হৃৎস্পন্দনে থামার ধ্বনি বাজে । পথের মাঝে জীবন জুড়ে , জীবন ব্যাপে মহৎপ্রাণ মহাত্মা অগ্রজ , সতীর্থ , অনুজদের ভালবাসার অফুরান শুভেচ্ছার মাঝেও অকৃতি অধম আমি প্রাণপণে কামনা করি তাঁদের হয়ে উঠবার । যোগ্য হয়ে উঠবার । মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনায় কাটাবার । আমার খুব স্নেহাষ্পদ এক ছোট ভাই নিপুণ এর মত করে বলবার ইচ্ছে জাগে , সব জ্ঞানের সেরা জ্ঞান কান্ডজ্ঞান যেন অন্ততঃ অর্জন করতে।