২০ জুলাই, ২০২০ বিডিনিউজ২৪.কম এ প্রকাশিত
গত চার মাস ধরে দেশের মানুষ নৈরাশ্যজনক অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলে যা আছে, তা শুধু দুর্বলই নয়, যথেষ্ট নড়বড়ে। শ্বাসকষ্টে দমবন্ধ হয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে মরা মানুষের কাছে নিত্য দৃশ্যমান। যুগের পর যুগ ধরে এদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বরং বহু বছর ধরে এর ব্যবহারে তা জীর্ণ হয়েছে। চকচক করে বেড়ে ওঠা বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত জনসেবা প্রদানে কত অদক্ষ, আর মুনাফা অর্জনে কত সুদক্ষ তা খুব নগ্ন ও স্পষ্ট। অথচ, সে অর্থে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আওয়াজ খুব ক্ষীণ। ঢাকার শাহবাগ মোড়-প্রেসক্লাব-পল্টন কিংবা চট্টগ্রামে চেরাগী-রেল স্টেশন চত্বরের ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে তা পৌঁছে না। বেদনায় ভারী হয়ে ওঠা মাতম দেখা যায় বহু মানুষ এর কলমে ও গলায়। সীমিত শক্তি সত্ত্বেও সমগ্র রাষ্ট্রের সকল যন্ত্রপাতি ও নাটবল্টুগুলো কেন নড়ে ওঠে না? প্রসঙ্গত একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে ভারতের কেরালা রাজ্য করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় দারুণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। অথচ অন্য রাজ্য, এমনকি কেন্দ্রের রাজধানী দিল্লিতেও সে সাফল্য অর্জিত হয় না। কারণ কী? কয়েকদিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় বদিউল আলম মজুমদার লিখেছেন, কেরালায় সাফল্য নিশ্চিত করেছে তার স্থানীয় সরকারগুলোর কমিউনিটি সম্পৃক্ত উদ্যোগ। কেরালার উন্নয়ন বাজেটের ৩৫ শতাংশ ব্যয়িত হয় তার স্থানীয় সরকারগুলোর মাধ্যমে। ফলে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার নয়, স্থানীয় সরকার এবং তার মাধ্যমে জনসম্পৃক্তি নিশ্চিত হয়েছে। মানুষকে আস্থায় নিয়ে, মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতার ভিত্তিতে আপাতত কেরালাকে সংক্রমণ মোকাবিলায় সাফল্য এনে দিয়েছে। সুতরাং, একটি শক্তিশালী কেন্দ্র, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় উদ্যোগ এর বিপরীতে কেন্দ্রাতিগ শক্তি যা সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অজস্র শক্তির স্ফুরণ ঘটায়। আমাদের রাষ্ট্র চিন্তার জগতে যা উপেক্ষিত। সে সরকারি হোক বা সরকারের বাইরে অবস্থানরত ডান-বাম, বিরোধী শক্তি যাই হোক না কেন! যদিও, মানুষ হচ্ছে রাষ্ট্র চিন্তার কেন্দ্রীয় বিষয়। কিন্তু, রাষ্ট্র চিন্তা ও পরিচালনায় মানুষের অংশগ্রহণের ভাবনা বরাবর মূল স্রোতের প্রধান শক্তিগুলোর কাছে উপেক্ষিত। একদল করিতকর্মা রাষ্ট্রীয় নির্বাহী, একদল চৌকষ দলীয় নির্বাহী, একদল চটপটে কর্পোরেট নির্বাহীর হাতে রাষ্ট্র, দল ও কর্পোরেট উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের পক্ষে জনগণ কি ভেড়ার পালের অধিক? প্রচারণার বিপুল তোড়ে, বিপণনের ক্যারিশমায়, বিজ্ঞাপনের চটকদারিত্বে আস্থা রাখেন এই নির্বাহীরা। জনগণ তাদের ভোট। জনগণ তাদের কাস্টমার। জনগণ তাদের হাতিয়ার। জনগণের শক্তির স্ফুলিঙ্গে এদের ভয়। সেই স্ফুলিঙ্গে অপরকে (পড়ুন প্রতিদ্বন্দ্বীকে) উৎপাটন করতে, বাজার থেকে সরিয়ে দিতে কিংবা স্ফুলিঙ্গ বশে রাখতে যাবতীয় আয়োজন তাদের।
জনগণ বিমূর্ত ধারণা নয়। জনগণ হল অজস্র বা কোটি কোটি জৈব সত্বা। যাদের প্রত্যেকের ঘাড়ের ওপরে আছে মাথা। যা চিন্তার জন্ম দেয়। যার অভিজ্ঞতা হয়। যার আনন্দ ও বেদনা আছে। এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সুবিশাল সমষ্টি ও অংশগ্রহণ পাল্টে দিতে পারে। এই বিপুল চিন্তাশীল মানুষ আপাত অসম্ভব বিবেচনাকে সম্ভব করে তুলতে পারে।
অতি সম্প্রতি কয়রা উপজেলার ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ প্রায় ১ মাসের অধিক সময় ধরে মেরামতের চেষ্টা করেও প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। অথচ, একদিনে ৭ হাজার মানুষ একত্রে সমবেত হয়ে হাজার হাজার বালির বস্তা ফেলে পুনঃনির্মাণ করেছে সে বেড়িবাঁধ। মানুষের সমবেত শক্তির সামর্থ্যের অসামান্যতা নতুন কিছু নয়।
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সবকিছুই কেন্দ্রীয়। খুব সামান্য পরিমাণের হোল্ডিং ট্যাক্স ব্যতীত স্থানীয় সরকারের আয় বলতে তেমন কোনো খাত নেই। অবশিষ্ট সকল খাত থেকে প্রাপ্ত আয় রাষ্ট্রের তহবিলে জমা হয়। রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের পরিকল্পনা মোতাবেক তা ব্যয়িত হয়। সুতরাং, একটি সড়ক কিংবা নর্দমা সংস্কার বা নির্মাণের জন্য সকল স্থানীয় সরকারকে তাকিয়ে থাকতে হয় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তহবিলের দিকে। দেশের আইন প্রণয়নের দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের। কিন্তু, আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উন্নয়ন তহবিলের অর্থ বরাদ্দের জন্য তারাও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। বস্তুত, আমাদের রাষ্ট্র পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার হাতে আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্র অত্যন্ত সীমিত। ঢাকার মেয়র পদে থাকাকালীন প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ সাহেব সিটি গভর্নমেন্ট-এর দাবি সম্মিলিত ধারণা উত্থাপন করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তার নিজ দলের তরফে কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী অপর দলের তরফে তেমন কোনো উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেনি। ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সে অর্থে কার্যকর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র স্থানীয় সরকারের পক্ষে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, বহুমুখী বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে কার্যকর নজরদারি যেভাবে সম্ভব, তা কোনো অবস্থাতেই একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। স্থানীয় এন্টারপ্রাইজসমূহ থেকে অর্জিত আয়ের নির্দিষ্ট হিস্যা বা অংশ দিয়ে বহুমুখী জনউদ্যোগ, জননজরদারী নিশ্চিত করা সম্ভব। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রেই এ ধরনের অজস্র নজির রয়েছে। অনেক বছর ধরে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞবৃন্দ এ সকল বিষয়ে তাদের চিন্তা তুলে ধরেছেন। কিন্তু, আমাদের রাষ্ট্র চিন্তা ও দর্শনের যে সাধারণ গতিমুখ তাতে শক্তিশালী কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় চিন্তা, কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় চিন্তকের ধারণা ব্যাপক ও প্রায় অনড় অবস্থানে। কিন্তু, আমাদের সমকালীন অভিজ্ঞতা যা সঞ্চিত হয়েছে সমকালে দেশ ও বিশ্বের অজস্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাতে বিকেন্দ্রীকৃত ধারণার স্বপক্ষে উদাহরণ প্রচুর। এমনকি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আজ প্রথাগত রাজনৈতিক দল ও শক্তির বাইরে স্বতঃস্ফূর্ত ও আপাত অসংগঠিত শক্তির নানারকম স্ফূরণ প্রত্যক্ষ করা গেছে।
ধরে নেওয়া হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যবস্থা হল ভোটের অধিকার ও ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের অধিকার। কিন্তু, এটি কেবল একটি প্রকাশ মাত্র। বরং, গণতন্ত্র হলো জনগণের মতামতের প্রতিফলন, জনগণের নিজস্ব মতের বাস্তবায়নে তার অংশগ্রহণ, যথাযথ ভাবে তা বাস্তবায়িত না হলে তার মতামতের পরিবর্তন হেতু প্রতিনিধি ফেরত আনার ক্ষমতা প্রয়োগেরও অধিকার। আমাদের সামগ্রিক রাষ্ট্র চিন্তার উপাদানের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে যা দারুণভাবে অনুপস্থিত। প্রথাগত রাজনৈতিক দল ও শক্তি যারা বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে জনগণের মধ্যে কাজ করেন, জনগণকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করেন, তাদের মধ্যেও এই বিকেন্দ্রীকৃত ধারণাকে দৃঢ় ভাবে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা তেমন দৃশ্যমান নয়।
করোনাভাইরাসের আগ্রাসী থাবা মোকাবিলায় চটজলদি উদ্যোগ নিতে অপারগতা, সীমিত সম্পদ ও শক্তি নিয়ে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলতে ব্যর্থতা পুনরায় উন্মোচন করেছে জনউদ্যোগ-জনসম্পৃক্তি-জননজরদারী নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ধাঁচের প্রয়াস যথেষ্ট ও কার্যকরী নয়। আমাদের সমাজের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সংহতির ভিত রয়েছে ঐতিহ্যগতভাবে পাড়া-গ্রাম-মহল্লাভিত্তিক কাঠামোর মধ্যে। আমলাতন্ত্র পরিচালিত রাষ্ট্র সহজাত সহযোগিতা ও সহমর্মিতার যে অপার শক্তি আমাদের সমাজ ধারণ করে, তাকে করে তুলেছে প্রায় অকার্যকর। করোনাভাইরাস মহামারীতে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গলদঘর্ম হয়েছেন মানুষের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণে, তখন রাজধানীর কল্যাণপুরে একটি আবাসিক এলাকার সমিতি অত্যন্ত সফলতার সাথে সুশৃঙ্খলভাবে তা পরিচালনা করতে পেরেছেন। যা সংক্রমণ মোকাবিলায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং, সমাজের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা জনশক্তির উন্মোচন ঘটাতে প্রান্তের দিকেই তাকাতে হবে। কেবল করোনাভাইরাস মোকাবিলা প্রশ্নেই নয়, শাসনযন্ত্রের ওপর জনগণের প্রত্যক্ষ নজরদারির প্রশ্নটি ব্যাপক অর্থে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মানুষের বাস্তব চাহিদার নিরিখে সমাধানের অজস্র স্থানিক কৌশল ও তার বাস্তবায়নে জন অংশগ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই আপাত অসাধ্য সম্ভব করতে পারে। যেকোনো কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা খুঁটিনাটি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে পারঙ্গম নয়। ব্যক্তি ও ব্যক্তি সমষ্টির অজস্র সৃজনশীল উদ্যোগ ও দক্ষতার চেয়ে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় প্রাধান্য পায় সাধারণ নির্দিষ্টকৃত নিয়ম। তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে, বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তাৎক্ষণিক ও যথাসময়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থার চেয়ে কার্যকরী নিদান অন্য কিছু হতে পারে না। বরং অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বৃহৎ প্রকল্প যা মেগা প্রকল্প কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় তা একটি বড় অংশ জুড়ে বিরাজ করে। কিন্তু, মেগা প্রকল্পের বাইরেও রয়ে যায় বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবনের চাহিদা। যা ধারণ, বহন ও পরিচালনা করতে বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনের দক্ষতার সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর বহুল আলোচিত দুর্নীতি যা জন অসম্পৃক্তির কারণে বাড়বাড়ন্ত হবার সুযোগ থাকে, জনগণের অংশগ্রহণ সে দুর্নীতির রাশ টানতে পারে। কারণ, পুরো প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্যের সাথে তার সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নজরদারির কাজটি হয়ে ওঠে সহজতর।
যেকোনো সমাজের উন্নয়ন, উদ্যোগ, সম্ভাবনা ও বিকাশের স্ফূরণ ঘটে মানুষের প্রাণময় ও জীবন্ত সংযোগের মাধ্যমে। আমলাতন্ত্র নির্ভর কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভবপর নয় বলেই দৃশ্যমান। অযুত মানুষের অজস্র সৃজনশীলতা ধারণ করার জন্য চাই তার ক্ষমতায়ন। একটি বিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্রযন্ত্র সম্ভাবনার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে।