প্রকৌশল বিজ্ঞান এর স্নাতক হতে পড়তে গিয়েছিলেন জার্মানি। মাত্র ছ’মাস বাকী তখন স্নাতক হবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুূ্দ্ধের টাল মাটাল সময়। ১৯৪২ সন। নেতাজী সুভাষ বসু পৌঁছে গেছেন বার্লিন। জার্মানির রাজধানী। সাক্ষাৎ হল নেতার সাথে। নেতাজী চাইলেন, এক্ষুনি তাঁর সাথী হোন আবিদ। সদ্য যুবা আবিদ বললেন, তাঁকে ছ’ মাস সময় দিতে। তিনি স্নাতক হয়ে সুভাষ এর সাথে যোগদান করবেন। নেতাজী বললেন, এটা স্বার্থপরতা। নিজের সবকিছু ঠিক ঠাক করে তারপর রাজনীতি করবেন, তা তো হয়না। এ রাজনীতি প্রয়োজন বলে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে যোগদান করতে হবে এক্ষুনি। আবিদ হাসান তাই করলেন। মূহুর্তের সিদ্ধান্তে তিনি হয়ে গেলেন নেতাজীর একান্ত সঙ্গী। জার্মানি থেকে ইউ বোট সাবমেরিন যাত্রার সফর সঙ্গী হলেন আবিদ। প্রতি মূহুর্তে শংকা ভয় উপেক্ষা করে, ৯০ দিনের যাত্রা শেষে তাঁরা স্থানান্তরিত হলেন জাপানী সাবমেরিনে।
আজ ভারতবর্ষের সকলেই জানেন ও চেনেন নেতাজীকে। ক’জন জানেন আবিদ হাসান সাফরানীকে? হায়দ্রাবাদ এর একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্ম তাঁর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এর সাথে ছিল এ পরিবারের আত্মিক বন্ধন। মা ছিলেন গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে একজন সক্রিয় সমর্থক। আবিদ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো পরিবারটিকে নেতাজীর ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
জীবনের শুরুতে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের সাথে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন গুজরাটের সবরমতি আশ্রমে। ১৯৩১ সালে কারাবন্দী হয়েছেন। উচ্চ শিক্ষা নিতে বার্লিন গেছেন। বার্লিনে পরিচিত হয়েছেন বোস এর সাথে। তারপর জার্মান সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ বন্দী ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে বোসের Indian League of Ligion এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। বোস এর সাথে নিয়মিত কাজের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন আস্থা। প্রবাসী ভারতীয় বেতারকেন্দ্রে কাজ করেছেন। ভয়াবহ অনিশ্চয়তা আর শংকার মধ্যে সাবমেরিনের ৯০ দিন যাত্রায় সর্বক্ষণ নেতাজীর বক্তৃতা, পরিকল্পনা ইত্যাদি সংরক্ষণ করেছেন।
সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, বার্মায় প্রবাসী তৎকালীন ভারতীয় জনগণ, যুদ্ধবন্দী ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে নেতাজীর গড়ে তোলা Indian National Army ( INA) বা আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সংগঠনকে পরিচালনা করতে সহযোগিতা করেছেন। যে বাহিনীর সশস্ত্র উইং এ সর্বোচ্চ ৫০,০০০ সৈনিক সারিবদ্ধ হয়েছিলেন। বেসামরিক লোকজন সহ তা কখনো লক্ষাধিক সংখ্যায় উন্নীত হয়েছিল। মেজর পদমর্যাদায় দায়িত্বরত ছিলেন। সর্বশেষ যে বিমানে স্থানাভাবে চড়তে পারেননি, সে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সুভাষ মৃত্যুবরণ করেন। ইম্ফলের যুদ্ধে পরাস্ত হওয়া এবং একইসাথে জাপানের আত্মসমর্পণ রচনা INA ‘র ভবিষ্যতে সমাপ্তি। যুদ্ধবন্দী হিসেবে বন্দী হন সিংগাপুরে। দিল্লির রেডফোর্টে যখন INA কমান্ডার শাহনেওয়াজ, ধীলন সহ শত শত INA ‘ র শরীক সৈনিকদের বিচার চলছিল, তখন জনতার অভূতপূর্ব ক্ষোভ, ক্রোধ এর পাশাপাশি রচিত হয় নৌ বিদ্রোহের ইতিহাস। যা ব্রিটিশ রাজকে আতঙ্কিত করে তোলে। বলা বাহুল্য, দু’শ বছরের ভারত শাসনামলে ব্রিটিশ রাজ প্রথম কেঁপে উঠেছিল ১৮৫৭ র সিপাহি বিদ্রোহে। আর পুনরায় তাঁর কেঁপে ওঠা INA’র প্রকাশে এবং INA সৈনিকদের বিচারের সময় জনতার অভূতপূর্ব ক্ষোভ ও পাশাপাশি নৌ বিদ্রোহের ঘটনায়। বলার অপেক্ষা রাখেনা, ভাগ ও শাসনের নীতিতে, ব্রিটিশ রাজ সাদা চামড়ার ব্রিটিশ সৈনিক ও পুলিশ তাদের নিরাপত্তার চাদর নিশ্চিত করেনি, করেছে দেশীয় পুলিশ ও সৈনিকের সহযোগিতা। সুতরাং, তার ক্ষমতার খুঁটিতে আগুন ধরলে আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন লেনিন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে চিহ্নিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ভাগাভাগির লড়াইয়ে। যে যুদ্ধ তখন চলমান। আর রাশিয়ার জারের পক্ষে রাশিয়ার শ্রমিক – কৃষকের সন্তানের জীবনদানকে তিনি অনর্থক অপচয় হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিলেন। লেনিন সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৎকালীন সৈনিকদের আহ্বান জানিয়েছেন, বন্দুকের নলের মুখ নিজের দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে। তিনি সফলভাবেই তা সম্পন্ন করে বিপ্লব করেছেন। কিন্তু, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী অগ্রগণ্য জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্ব সরাসরি সংগ্রামের পথে হাঁটার চেয়েও আপোষ – আলোচনা – মীমাংসার পথে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি যে কমিউনিস্টরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁরাও রাশিয়া আক্রান্ত হবার সাথে সাথে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের পথ স্থগিত রাখাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, জাপানী আগ্রাসন বিরোধী লড়াইয়ে গৌরবময় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্টরা সফল বিপ্লব সম্পন্ন করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
জার্মানি, জাপান আর ইতালির সহযোগিতা নিয়ে নেতাজী বোস, ভারতীয় সংগ্রামের কোন সফল পরিণতি আনতে পারতেন কীনা তা আজ কী হতে পারত আর পারতনা, সে রকম সম্ভাব্যতার আলোচনা মাত্র। কিন্তু, ভারতীয় জনগণ এর মধ্যে নেতাজী যে উচ্চতার ভালোবাসা ও সমর্থন অর্জন করেছিলেন যুদ্ধকালে ও যুদ্ধ পরবর্তীতে তা নিয়ে কোন সংশয় নেই।
আবিদ হাসানের মত অজস্র মানুষের জীবনের সাথে এ সংগ্রাম যুক্ত হয়েছিল জীবন পণ হিসেবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে অনুনয়, বিনয় আর আকুতি জানিয়ে যে বিদায় করা সম্ভব হতনা, তা বারেবারে নির্মমতা দিয়ে ব্রিটিশ রাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন।
একজন আরেকজনকে সম্ভাষণ জানানোর ক্ষেত্রে অনেক জায়গাতেই মানুষ ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু, INA একত্রিত করেছিল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষকে। সুতরাং, তাদের পারষ্পরিক সম্ভাষণ এর একটা অভিন্ন রেওয়াজ দরকার ছিল। আবিদ হাসান নিয়ে আসলেন ” জয় হিন্দ”.। বাংলায় ” ভারতবর্ষের জয় হোক”। আবিদ হাসান শুধু এটুকুর জন্যই ইতিহাসের আসন পেতে পারেন।
আবিদ হাসানের মত মেধাবী, আত্ম সমর্পিত অজস্র বিপ্লবীর অকুণ্ঠ ভালোবাসাই নেতাজীকে দুঃসাহসিক পথে চলার সাহস যুগিয়েছিল। মাত্র ক’দিন আগেও আবিদ হাসানের নাম জানতাম না। সদ্য হাতে পাওয়া বই ABID HASAN SAFRANI, NETAJI’S COMRADE – IN -ARMS এর বদৌলতে তাঁকে জানা। স্বাধীন ভারতের হয়েও তিনি অসামান্য যোগ্যতায় প্রবাসে ভারতীয় মিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন। পন্ডিত নেহেরুর নিজ হাতে বাছাই করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আবিদ হাসান সাফরানির প্রতি শ্রদ্ধা।
” মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলীদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।”
ছবি : আন্তর্জাল