অক্সফোর্ডে ঘুরে আসার হিজিবিজি দিন

মার্চ ১৯, ২০২৪

শৈশব থেকেই নাম শুনেছি অক্সফোর্ড,  কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের। জ্ঞান,যশ খ্যাতি, স্বীকৃতির অনন্য উচ্চতায় অক্সফোর্ড। ছিলাম হোয়াইট চ্যাপেলে। টিকেট কিনলাম হোয়াইট চ্যাপেল টু অক্সফোর্ড।  গেলাম হোয়াইট চ্যাপেল স্টেশন।  ট্রেন সহকারী জানালেন, হোয়াইট চ্যাপেলে ন্যাশনাল রেল টিকেট এর প্রিন্ট হবে না। ভিন্ন একটা স্টেশন থেকে টিকেটের প্রিন্ট নিয়ে আসতে বললেন।  হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। অগত্যা,  জুলফিকার এর পরামর্শে টিকেট ক্যানসেল করা হল। কিছু গচ্ছা গেল । বহু বছর পরে দেখা জুলফিকার এর সাথে।  প্রায় ১৬ বছর তো বটেই। সদা হাস্যমুখ জুলফি’র মুখে চুলে সাদা’র পরশ লেগেছে। মেরিলিবোন স্টেশনে নিয়ে  অক্সফোর্ডগামী ট্রেনে আমাদের তুলে দিল জুলফিকার।  অক্সফোর্ড যাবার পথে বেশ কিছু স্টেশন। ছোট একটা শহর অক্সফোর্ড। ৩৯ টা আধা স্বায়ত্তশাসিত কলেজে প্রায় ২৬,০০০ ছাত্র ছাত্রী। এ অবধি ব্রিটেনের অন্তত ৩০ জন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।  ৭৩ জন সাবেক ছাত্র নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন। এমনকি অলিম্পিক পদক জয়ী এলামনাই এর সংখ্যা বিপুল।  হাজার বছর আগে গোড়াপত্তন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইংরেজি ভাষী প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান- বিজ্ঞান -প্রযুক্তি -সাহিত্য- অর্থনীতি – দর্শন – চিত্রকলা- গবেষণা  প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অক্সফোর্ড সারা দুনিয়ায় শীর্ষস্থানীয়। ইংরেজ রয়াল ফ্যামিলির আশীর্বাদপুষ্ঠ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ও বেশ পুষ্ট। বিগত সহস্রাব্দের ইংলিশ রাজ ও চার্চ যুগপৎ সমর্থন যুগিয়েছে এতে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যুগে জ্ঞান চর্চার ক্রমবর্ধমান ভূমিকার গুরুত্ব বুঝেই সারা পৃথিবীর বুকে নেতৃত্বের আসনে বসতে শুরু করা ব্রিটিশ রাজের জন্য এটা জরুরীও ছিল।  এমনকি রয়্যাল পরিবারের ভূমিকা কমতে থাকা স্বত্বেও আধুনিক পুঁজির দুনিয়ায় জ্ঞান উৎপাদন এর প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। জ্ঞান বুদ্ধির জগতে অক্সফোর্ড এর মত প্রতিষ্ঠান সহস্র বছরে সমৃদ্ধ হয়েছে সকল ব্রিটিশ এস্টাবলিশমেন্টের স্নেহ বাৎসল্যে।

এমন একটা জগৎ বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার আগ্রহ ছিল বহুকাল।সুতরাং,  প্রথম লন্ডন ট্যুর এর দ্রষ্টব্য তালিকায় ছিল অক্সফোর্ড।  ট্যুরিস্ট এর সংখ্যা ছিল যথেষ্ট। আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁও কম নয়। রয়েছে হপ অন হপ অফ বাস। সাইকেল। প্রথমে ঘন্টা খানেক ধরে হেঁটে ঘোরা হল। এক মিউজিয়ামে ঢুকে দ্রুত বের হয়েও লেগে গেল প্রায় ঘন্টা। বলা হয়ে থাকে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়াম। বিদ্যা চর্চা তো শুধু বইয়ে মুখ গুঁজেই হয়না। মানুষের মনুষ্যোচিত বিকাশের প্রক্রিয়া,  সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশের ধারা এসমোলিয়ান মিউজিয়ামে তুলে ধরার প্রয়াস। চিন্তা করে দেখলাম  এভাবে তো সারা দিনেও ট্যুর শেষ হবে না। আমাদের একই দিনে ফেরার প্ল্যান।  উঠে পড়লাম একটা হফ অন বাসে। হেডফোনে ধারা বিবরণী আর দেখতে দেখতে ঘোরা হল। এক একটা ভবন আর সড়ক যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।  খেলার মাঠ, লাইব্রেরি,  প্রদর্শনী, নানান মিউজিয়াম। পথের ধারে দোকান,  কফি শপ, রেস্তোরাঁ,  পাব।  পতাকা হাতে নিয়ে কেউ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন গাইডেড ট্যুরে। কয়েক ঝাঁক শিশুদের দল এর দেখা মিলল। এরা এসেছে স্কুল থেকে।  শিক্ষকেরা আছেন সামনে পেছনে।  এমনই বেশ কয়েকটি দলের দেখা মিলেছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও। দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ,  আবার মিউজিয়ামে ছবি দেখে ছবি আাঁকা।  সবই তাদের জন্য জগত পাঠ প্রক্রিয়া। অক্সফোর্ডে মিউজিয়াম দেখতে কোন ফি লাগে না। তবে ডোনেশন বক্স রয়েছে।  চাইলে কেউ দান করতে পারেন। স্যুভেনির শপ যথেষ্ট।

বলা বাহুল্য,  অক্সফোর্ডের গবেষণার বাজেট বেশ বড়। সরকারি বরাদ্দের বাইরেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এর অনুদানের পরিমাণ ও ভারী। ধারা ভাষ্যকার তখন বলে চলেছেন পেনিসিলিন থেকে কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অক্সফোর্ড গবেষণার কথা। মনে হচ্ছিল যেন,  ইতিহাসের পাতা থেকে নোবেল জয়ী আলেক্সান্দার ফ্লেমিং, চেইন,  ফ্লোরী এঁরা হেঁটে চলেছেন এই ক্যাম্পাসে।

মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আাসি ট্রেন স্টেশনে ।  জুলফিকার এর পাঠানো ম্যাসেজে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ার কথা যে ট্রেনের, সে একই সময়ে আরেকটি প্লাটফর্মে অন্য একটা ট্রেনে উঠে পড়ি। ফেরার পথে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল জুলফিকার এর বাড়ি। তার স্ত্রী সেতু আমাদের জন্য ইফতার ও রাতের খাবারের আয়োজন করেছে। ভুল ট্রেনের ভুল ডিরেকশনে আমরা ইতিমধ্যে জুলফিকার এর বাড়ি ফেলে চলে এসেছি লন্ডন।  আবার কাজ করছেনা ঠিক মত মোবাইল ফোনের ডাটা। ফলে,  ট্রেন স্টেশন প্লাটফর্ম কোনটায় যাব,  আর কোন ট্রেনে, কোন ডিরেকশনে উঠব,  এ নিয়ে বড্ড ঝামেলায় পড়ি। যাই হোক আক্ষরিক অর্থে জালের মত ছড়ানো লন্ডন টিউব,  ট্রেন, আন্ডারগ্রাউন্ড আর ওভারগ্রাউন্ড এর গোলকধাঁধা আরো ভালো করে বুঝতে পারি। কিন্তু,  ততক্ষণে অযথা আরো প্রায় দেড় ঘন্টা গেল।

যাই হোক,  অবশেষে আমরা অক্সফোর্ড ভ্রমণ এর
সারা দিনের হিজিবিজি  শেষে জুলফিকার -সেতুর বাড়ি পৌঁছি। ইফতার ও রাতের খাবারের আতিথ্য নিয়ে সুন্দরভাবেই হোটেলে পৌঁছি। অক্সফোর্ড ভ্রমণের জন্য যেমন,  তেমনি সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঝক্কি ঝামেলার জন্য,  ঠেকে শেখার জন্যও স্মরণীয় হয়ে রইল।