সিটি অব জয় : মাজমা- উল – বাহরাইন কোলকাতার কলেজ স্ট্রীট, প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং,সেন্ট পলস ও নেতাজী মিউজিয়াম

এপ্রি ২৩, ২০২৩

শহর কোলকাতা, প্রধানত ব্রিটিশ কোলকাতার সড়কের নামগুলোতে শুধু বাংলা বা ভারত নয়, সারা দুনিয়ার স্মরণীয়-বরণীয়, নন্দিত- নিন্দিত বিখ্যাত – কুখ্যাত কিন্তু স্বনামখ্যাত মানুষের নাম চোখ এড়ায়না। কলোনিয়াল লেগাসির ছাপ এ শহরের সড়ক আর ভবন জুড়ে। নগর কোলকাতার বয়স যেমন অনেক হোল, তেমনি তার সড়ক ও ভবনের অনেক গুলোতেই তার ছাপ খুব স্পষ্ট।

ব্রিটিশ স্থাপত্যের পাশাপাশি, দেশী বাড়ি, ঘিঞ্জি বস্তি, ইট সুরকি ধ্বসে পড়ার অপেক্ষমান বাড়ির সনাতন কোলকাতা গত তিন দশকে আমুল পাল্টে গেছে। মহানগরীর ফ্লাই ওভার, মেট্রো, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সুউচ্চ পাহাড়ের মত হাইরাইজ ভবন, ঝকমকে সুপার মল, চেইন রেস্তোরাঁ, পোষাক, দারুণ সব গাড়ি, ব্রান্ডেড শপ আর দিশি চোলাই মদের স্থলে বিলেতী মদের দোকান এখন রাশি রাশি।

তবুও, তার পাশেই টিকে আছে এখনো ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং বাণিজ্য। টিমটিমে হলেও পুরনো রেস্তোরাঁগুলো এখনো অস্তিত্ব জানান দেয়। বনেদী আভিজাত্য কোলকাতা ধরে রেখেছে এখনো অনেকটাই। তাজ, গ্রান্ড, এইচ এইচ আই এর পাশাপাশি এখন আইটিসি, জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট, ওয়েস্টিনসহ একগাদা পাঁচ তারকা হোটেল এর ছড়াছড়ি। ঝকঝকে সুপার মলের পাশাপাশি নিউমার্কেটে ভীড় বিক্রি এখনো যথেষ্ট। শত শত ফুড চেইন, অন লাইনে অর্ডার করা ফুড ডেলিভারি আ্যাপস এর পাশাপাশি স্ট্রীট ফুড স্বমহিমায় এখনো দাঁড়িয়ে ।

আজ দিনটি আমাদের ঘোরাঘুরির সাথী হবার কথা ছিল Arka Bhaduri অর্কের। কিন্তু, আকষ্মিকভাবে তার পেশাগত কাজের জন্যই উড়ান দিতে হল কাঠমান্ডুতে। আগামীকাল তার প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডের সাথে ইন্টারভ্যু। সুতরাং, আমি ও লীনা এবং ভ্রাতৃকন্যা কৃত্তিকা মিলে বেরিয়ে পড়লাম।

কলেজ স্ট্রীট বই পাড়া। সেই ব্যস্ততা। সরু গলি। সর্বক্ষণ যানজট। গা ঘেঁষে মানুষের হাঁটার দৃশ্য। একই রকম। নোট বই, পাঠ্য বই, গাইড বই, কম্পিটিটিভ এক্সাম এর বইয়ের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। ঠিক যেন ঢাকার বাংলাবাজার বা চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা বই পাড়া। সৃজনশীল বইয়ের বনেদী দোকানের পাশে ছোট ছোট আউটলেট নিয়ে এখনো অনেক প্রকাশক। দে’জ, আনন্দ, ন্যাশনাল আছে। আছে স্বল্পখ্যাত অনেক দোকান। কয়েকটি বইয়ের সন্ধানে ধ্যানবিন্দু খুঁজে বার করা হল। কাঙ্ক্ষিত বই পাওয়া গেলনা। অন্য কয়েকটি দোকানে কিছু কেনাকাটা হল। খাবার পালা এল। দুপুর গড়িয়েছে তখন।

সুমনের গানে শুনেছিলাম “প্রথমবার নিজামে গিয়ে কাবাব ভরপেট”। কথা ছিল আজ আমরা নিজামে খাব। দেরী হয়ে যাওয়ায় কাছে কোথায় যাওয়া যায় তাই ভাবছিলাম। পাওয়া গেল। কলেজ স্ট্রীট এর গা ঘেঁষেই রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট। এখানেই তিরিশটা কক্ষ নিয়ে গত শতকের শুরুতে গড়ে উঠেছিল প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউজ। ওতে থাকতেন ব্যোমকেশ বক্সী লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি জীবনানন্দ দাশ। ঐ বোর্ডিং এর লোকজন খেতেন একই ভবনের নীচতলায় ” মহল ” নামের খাবার দোকানে। একবারেই বাঙালি খাবার। নানান ভাজা, নানান পদের মাছের ঝোল, মাংস আলু ঝোল, নানান পদের সবজি, ডাল ইত্যাদি। কলাপাতা সমেত খাবার। জনা তিরিশ লোক বসতে পারেন। বাইরে অপেক্ষায় লোক। পার্সেল খাবার যাচ্ছে দেদার। সাদা হোয়াইট বোর্ডে খাবার মেনু আর দাম। আগে কেমন ছিল খাবার তা তো বলতে পারব না। তবে আমাদের বেশ লেগেছে। ভারী মজাদার। রসনা বিলাস হল। বোর্ডিং হাউজটি বন্ধ। ভবনের জীর্ণ দশা। ভেঙে পড়ে কখন তাই বলা মুশকিল। “মহল” এর দেয়ালে তাঁদের পুরনো বোর্ডার বহু নন্দিত লেখকের লেখা আর ছবি আটকানো। গত শতকের স্বাদ আর গন্ধ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

মহল রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড

কোলকাতার দ্রষ্টব্য স্থান সেন্ট পলস চার্চের চুড়ো দেখা যেত অনেক দুর অবধি। এখনো যায় অনেকটা। তবে আরো শত শত উঁচু ভবনের চুঁড়োর নীচে কিছুটা ম্লান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত কলোনিগুলোতে প্রথমদিকককার বিশাল চার্চের একটি সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। আঠরশ শতকে এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪,৩৫,০০০/- টাকা। ২০১ ফুট উচ্চতায় এর চুঁডো। স্থাপত্য হিসেবে অসাধারণ সুন্দর। ঘুরে ফিরে দেখা হল। দশ টাকা প্রবেশ মুল্য মাত্র। বেশ খোলামেলা চারদিকে। বড় বড় গাছ। মাঝে চার্চ। স্নিগ্ধ মনোরম। গত দুই শতকের দুটি ভূমিকম্পে এর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পর এটি পুননির্মাণ করা হয়।

সেন্ট পলস চার্চ

সর্বশেষ গন্তব্য ছিল নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এর বাড়ি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক সময়ের সভাপতি, যিনি মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা স্বত্বেও সভাপতি হতে পেরেছিলেন স্ব যোগ্যতায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক ছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। দুঃসাহসিক অভিযানে পালিয়ে গিয়েছিলেন বার্লিন। হিটলার এর সহযোগিতায় তাদের সাবমেরিনে করে জাপানের সাহায্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুমাত্রা। সিংগাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে ভারতমুখী অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবন বহু রঙে বর্ণাঢ্য। তাঁর ভাই শরত বোসও ছিলেন নিবেদিত স্বাধীনতা সংগ্রামী। রহস্যময় কারণে তাঁর মৃত্যু নিয়ে এন্তার জল্পনা হয়। তাঁর বাড়িটি আস্ত একটা মিউজিয়াম। বাড়িতে তাঁর জীবন, কৃতি, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক নানান স্মৃতি ধন্য বিষয়ের পাশাপাশি রয়ে গেছে যে গাড়িটি নিয়ে তিনি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। চলে গিয়েছিলেন বার্লিন, সেই গাড়িটি আস্ত রাখা আছে। রয়েছে নানান ভিডিও, স্থির চিত্র, চিঠিপত্র। নীচতলায় লাইব্রেরি। সুভাস বোস এর জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত বইপত্র। কয়েকটি সংগ্রহ করা হল।

যে গাড়ি নিয়ে সুভাস বোস ভারত ছেড়েছেন

সুভাষ বোস মিউজিয়াম থেমে সংগৃহীত

ফিরছি যখন ভ্রমণ শেষে, তখন সূর্য অস্তগামী। একদিন এ শহরের কাছেই ভারতবর্ষের প্রথম একটি দেশীয় রাজত্বের স্বাধীনতা অস্তমিত হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলার অস্তগামী সাম্রাজ্যের উপর, ইংরেজরা গড়ে তুলেছিলেন তাদের প্রথম রাজধানী এ শহরেই। খানিকটা দূরেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, তাই মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা। তবে তাদেরই শিক্ষায় শিক্ষিত একদল মানুষের অন্যতম পুরোধা সুভাস বোস সহ আরে অজস্র মানুষের আত্মদানে ইংরেজ সাম্রাজ্য অস্তমিত হয়েছে।

সুভাস বোসের মিউজিয়াম লাইব্রেরি থেকে কেনা হল ” ABID HASAN SAFRANI, Netaji’s Comrade – in – arms “। নেতাজী সুভাষ বসু, আবিদ হাসানরা যখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতের অজস্র জাতি- বর্ণ- ধর্মের মানুষের মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়া জীবনের, নয়া স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করছিলেন, তখনো বিভেদের শক্তি – একদেশ দর্শী সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে সংগ্রামকে পরিচালিত করতে চাইতেন, আজো তাদের সেইসব অপচেষ্টা থেমে নেই।

মানুষের জীবনের সাধনা অজস্র – লাখো কোটি মানুষের মিলন সাধনা। আগামীকাল সে ভোরের সূর্য দেখার অভিলাষ জেগে থাকে। স্বপ্ন বেঁচে থাকে।

মুঘল শাহজাদা দারাশুকো একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন মাজমা- উল – বাহরাইন এর। বহুত্ববাদী চিন্তা, মত ও পথের মিলন সাধনার। নগর কোলকাতার জীবন ও কর্মে তার ছাপ মুছে যাবার নয়। মানুষের বহুত্ববাদী চিন্তার ঐক্য বেঁচে থাকে যুক্ত কাজের সাধনায় ও সংগ্রামে। তাতেই ভরসা রাখি। বিভেদের ব্যবধানে ও আস্ফালনে নয়।

৬ এপ্রিল ২০২৩।