গতকাল যখন এ শহরের ট্রেন স্টেশন ওয়েভারলিতে নামি তখন ঘড়ির কাঁটায় ৪ টা ১০। প্রায় ১ ঘন্টা অনাকাঙ্খিত যাত্রা বিরতি ছিল রেলপথে ভূমিধ্বস জনিত বিরতির কারণে। কোন হইচই চেঁচামেচি নেই। অপেক্ষার পালা শুধু। যদিও আমরা উদ্বেগে কাটিয়েছি। হোটেলে বুকিং। ফিরতি ট্রেনের টিকেট। সব বুঝি গচ্ছা গেল । যাই হোক পৌঁছাতে পারলাম শেষ অবধি।
স্টেশনে নেমে ম্যাপ ধরে হেঁটেই চলে গেলাম হোটেলে। ১২ মিনিটের পথ। হোটেলে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম খাবার অন্বেষণে। আমাদের থাকার জায়গার বিপরীতে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ। রোটি নাম। বিরিয়ানি খেলাম। তারপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হেঁটে গেলাম। কাছেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়। দারুণ আর্কিটেকচার। ছবি তোলা হল। সুন্দর একটা বুকশপ ব্ল্যাকওয়েলস বুকসেলার । নান্দনিক পরিবেশনা।
অতঃপর কার্লটন মনুমেন্টের উদ্দেশ্যে। বেশ উঁচুতে। শহর দেখা যায়। আমার সফর সঙ্গী লীনা দেখলাম মাঝপথে কাহিল। জানতে চাইলাম, “তুমি কী উপরে উঠতে পারবে? না, অন্য কিছু করবে?’ বেচারি মুখ কালো করে বলল, ” আপাততঃ হোটেলে চলে যেতে চাই। ” তবে তাই হোক। তাঁকে হোটেল কক্ষে পৌঁছে দিয়ে, আমি বের হলাম সন্ধ্যায়।
এয়ারপোর্ট গামী ট্রাম এর রিটার্ন টিকেট কেটে নিয়ে ট্রাম চেপে বসলাম। রাতের আলো আাঁধারীতে শহরটা কেমন যেন মায়াবী শহর বনে যায়। টানে, কেবল টানে। এয়ারপোর্টে যেহেতু কোন কাজ নেই। কাজেই দুটি স্টেশন আগে নেমে আবার ফিরে এলাম উল্টো পথে।
পথের ধারে জনা কয়েক হোমলেস মানুষের দেখা মিলেছে। সব বড় শহরেই মেলে।। ঠান্ডা ভীষণ। গতকাল দিনের তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। রাতে ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যানবাহনে আর যে কোন ঘরে হিটার। কিন্তু, খোলা রাস্তায় তো প্রকৃতি স্বরুপে প্রকাশিত। গেঞ্জি, শার্ট, সোয়েটার, জ্যাকেট, হুড, মাফলার, হাত মৌজা। তবুও, এদিকে ঠান্ডা লাগে। ওদিকে পা হিম হয়ে ওঠে। এ আবহাওয়ার মধ্যেও মানুষ বাঁচে, সাজে, গায়, বেড়ায়, খায়, কাজ করে। অনভ্যস্ত আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। রাতে একটা ফিলিস্তিনী মালিকানার রেস্তোরাঁ থেকে চিকেন শর্মা নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আর, বেঁচে ও থাকি। সকালে দিব্যি উঠি।
আজ সকালে যথেষ্ট সময় নিয়ে উঠি। সকল সমাপনান্তে হেঁটে যাই। খুঁজে নেই হপ অন হপ অফ বাস। বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি। ঠান্ডা হাওয়া যেন সুঁই হয়ে বিঁধে। খুব বেছে বেছে কয়েকটা স্টেশনে নামব। এটা ঠিক করি। কিন্তু, নামতে ইচ্ছে করে অনেক জায়গায়। গাড়ি চলতি পথে ঘোষণা আসে এ হল স্যার জেমস সিম্পসন এর ভাস্কর্য। পৃথিবীর বুকে এনেস্থিসিয়ার আবিস্কারক। আহা, দুনিয়ায় মানুষের জীবনে কোন একটা মানুষের শরীরে অপারেশন এর সময় যদি তাকে এনেস্থিসিয়া দেয়া না যায়, কী ভয়ংকর পরিস্থিতি আর অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে তাকে যেতে হত, ভাবা যায়? আমাদের পূর্বসূরী মানুষেরা এ কষ্টের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন বেদনায় নীল হয়ে। বৃষ্টির জন্য আজ সিম্পসনকে স্যালুট জানাতে পারিনি। যদিও তিনি আমাদের অপেক্ষায় নেই।
প্রচুর স্কটিশ মানুষের অবদান আছে বিশ্বজুড়ে মানুষের অগ্রগতিতে।
নামলাম এডিনবারা ক্যাসেলে। প্রায় হাজার বছরের পুরনো দুর্গ। শক্ত পাহাড়ি পাথরের উপর নির্মিত এ দুর্গ। মধ্যযুগে যুদ্ধের জন্য প্রতিরক্ষা আয়োজন নির্মিত হত দুর্গ প্রাকারে। পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্যতায় এরকম সব দূর্গের অস্তিত্ব ও ইতিহাস পাওয়া যায়। শহরের ভেতরে শহর। রাজ্যের মধ্যে নিরাপদ রাজ্য। শত্রুপক্ষকে ঠেকিয়ে রাখতে অজস্র আয়োজন। যদিও আমার কাছে মনে হোল, দিল্লির লাল কেল্লা ( Red Fort) আর তুর্কী বাদশাহদের দুর্গ এডিনবারা ক্যাসেল এর চেয়ে আকারে প্রকারে বড়। তবে, মনে রাখা দরকার এডিনবারা ক্যাসল এর বয়স এদের চেয়ে অন্তত পাঁচ শত বছরের অধিক পুরনো। ক্যাসেল এর ভেতর অডিও ভিডিও প্রেজেন্টেশন আছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যটক আকৃষ্ট করে এ ক্যাসেল। বৃষ্টি আর ঠান্ডা গায়ে নিয়ে নেমে আসি ক্যাসেল থেকে।
ক্যাসেল থেকে নেমেই ডাকে মায়াবী এডিনবারা নানানভাবে। সকলের জানা, স্কচ হুইস্কির বাজার জগত জুড়ে। দু চারশ বছরের পুরনো স্কচ কোম্পানি শতাধিক। যারা এ পানীয় ব্যবসা করছেন বংশ পরম্পরায়। পানীয়ের স্বাদ নেয়ার আমন্ত্রণ দেয়ালে দেয়ালে। বিজ্ঞাপনে।
আমরা এগিয়ে যাই। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের দিকে। বিশ্বখ্যাত হ্যারী পর্টারের লেখিকা জে কে রাউলিং এখানে লিখতেন একসময়। এ সড়ক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ছবি তোলার জায়গা এডিনবারায়। রোমেই যখন, তখন রোমান হই। আমরাও নানান ঢং এ না হলেও, নানান ভাবে ছবি তুলি।
আবার উঠে পড়ি বাসে। বাস যায়। ইতিহাস বর্ণনা হতে থাকে। বৃষ্টি চলছে। গন্তব্যে নামি। হোটেলে ফিরে আসি।
বিশ্রাম নিয়ে খানিকটা, আবার বেরিয়ে পড়ি। এবড়ো থেবড়ো ঘুরে বেড়াই। এখানে দাঁড়াই। ওখানে এবং সেখানেও। ফ্রাংকেনস্টাইনের নামে বারের সামনে দাঁড়াই। এ শহরের প্রায় প্রতিটি সড়ক জুড়ে বার। স্কচ।
এ শহরের মানুষের লড়াই ইংলিশ জীবন এর মাঝে থেকে ও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার লড়াই। স্কটল্যান্ড বরাবরই তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে কেবল তার স্কচ হুইস্কির আবিষ্কার দিয়ে নয়, প্রচুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়েও। এরকম একটা দুটো আবিষ্কারেও কোন জাতির অহংকার এর জন্য যথেষ্ট।
আর, বলাই বাহুল্য এডিনবারা যে মোহনীয় কমনীয় রুপে বর্তমান, তা বোধ করি টানবে আমায় আরো বহুবার, যদি বেঁচে থাকি।