হায়দ্রাবাদে পাঁচ দিন :ডাক্তার – পথ্য – হালিম – দূর্গ – সংগ্রাম ও ভালোবাসা

এপ্রি ২৪, ২০২৩

চারদিন হল হায়দ্রাবাদ এসেছি। উপলক্ষ্য স্ত্রী’র ও নিজের চিকিৎসা। পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। হঠাৎই জানা হল AIG Hospital শুধু ভারত নয়, এশিয়াতেই গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজির জন্য বিখ্যাত। যার নির্মাতা ও চেয়ারম্যান নাগেশ্বর রেড্ডি পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ খেতাবজয়ী স্বনামখ্যাত গ্যাস্ট্রো চিকিৎসক।

মাত্র দশদিন আগে আমার ও আমাদের পেশাসহ বহু মানুষের ভালোবাসাসিক্ত বাচ্চু ভাই এখানেই নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী’র অস্ত্রোপাচার ও চিকিৎসা করিয়ে গেলেন। তাঁর কার্যক্রম ও অভ্যস্ত জীবনের ব্যস্ততাকে চেপে তাঁকে ভাবীর চিকিৎসার জন্য এ শহরে কাটাতে হয়েছে এক মাস। তাঁকে জিজ্ঞেস করা মাত্রই এক নিঃশ্বাসে বলে চললেন কী করতে হবে। কোথায়, কাকে বললে সকল প্রি বুকিং নিশ্চিত হবে। আমার নিজেরও হৃদযন্ত্রের সমস্যা। সুতরাং, দেরী না করেই প্রস্তুতি নিলাম।

আসার আগেই বাচচু ভাই বারংবার সব প্রস্তুতি নিয়ে খবর নিচ্ছিলেন। প্লেনে চড়ার আগেই AIG ‘র বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্রের প্রতিনিধি মৃনাল, যিনি নিজেও আন্তরিক এবং সদা তৎপর। তিনি জানালেন, বাচ্চু ভাই খবর নিয়েছেন আমাদের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে কীনা? প্লেনে ওঠার আগেই বুকটা স্নিগ্ধ হয়ে গেল। পৌঁছা মাত্র আবার তাঁর ফোন। ঠিক ঠাক হল কী সব?

চট্টগ্রাম হয়ে কোলকাতা, কোলকাতা থেকে দু’ঘন্টার বিমান পথে হায়দ্রাবাদ। এয়ারপোর্ট থেকে হাইটেক সিটি খ্যাত হায়দ্রাবাদ এর এক্সপ্রেস সড়কজুড়ে বিপুল গাছপালা, সবুজ সড়ক বিভাজক দেখতে দেখতেই হোটেল। ছিলাম Hotel Deccan Serai Grande। ভারী পরিচ্ছন্ন হোটেল। হোটেল লবির সাথে লাগোয়া ওদের রেস্টুরেন্ট Roast 24/7। দিনরাত খোলা। সমৃদ্ধ মেনু। হোটেল ভাড়া যথাযথ। খাবারের দাম কিছু বেশি। তবে মান উন্নত। প্রাতঃরাশ কমপ্লিমেন্টারি।

সকালে ব্রেকফাস্ট সেরেই হাসপাতালে। মৃনাল বাবু আগেই বলে রেখেছেন কোথায়, কার সাথে কঘা বলতে হবে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে। আরো বাংলাদেশী পেলাম। বিদেশি রোগীদের বেশির ভাগ যথারীতি আমাদের দেশের। ভারতের আরো কয়েকটি হাসপাতালের ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক দেখেছি। রোগী ভর্তি অবধি তাদের পাওয়া যায়। এরকম বড় হাসপাতালের কোথায় যে কোন ডেস্ক, তা খুঁজে পেতেই যথেষ্ট সময় অপচয় হয়। ইন্টারন্যাশনাল ডেস্কে কর্ণধার Dr. Lovit। কর্ণাটক এর নারী। সদা হাস্যমুখ। আমাদের সার্বক্ষণিক সময় দিলেন Naimraching Chin। ত্রিপুরার কন্যা। মারমা জনজাতির। ভালো বাংলা বলেন। হাসপাতালে পৌঁছেই বেলা ১১ টায় ফোন এল আবার। সেই বাচ্চু ভাই। কী করছি, এপয়েন্টমেন্ট ঠিক আছে কীনা, কাকে উনার কথা বললে দ্রুত সাহায্য পাওয়া যাবে, কোথায় খাব, কী খাব সব পরামর্শ দিলেন।

সব মিলিয়ে একগাদা টেস্ট আর আমাদের দুজনের জন্য ৬ জন চিকিৎসক এর ( কারো কারো দুবার) এপয়েন্টমেন্ট ও শেষ হোল মাত্র ৪ দিনেই। ভারতে চিকিৎসা, চিকিৎসক, হাসপাতাল আমার জন্য নতুন নয়। প্রতিটি দিন বাচ্চু ভাই খবর নিয়েছেন দু’বার, তিনবার। খবর নিয়েছেন আরো অনেকেই। অনেক বন্ধু ও স্বজন। তবে বাচ্চু ভাই যা করেছেন তা কেবল পরিবারের মুরুব্বি বা অভিভাবক, বড় ভাই, আাবা – মা তাঁরাই করেন। বারে বারে তিনি আমার বিস্ময়কে ছাড়িয়ে নতুন বিস্ময় নিয়ে আসেন। আমার মনে পড়ে যায় সেই ২০১৬ সনে। আমার হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে টানা ৯ দিন ছিলাম দিল্লি। একটি দিনও ছিল না, তিনি খবর নেননি। তিনি নিজেই নিজের উচ্চতাকে অতিক্রম করেন পোলভল্টের কিংবদন্তী সের্গেই বুবকার মত। মানবিক মানুষের জীবন্ত উদাহরণ হয়ে থাকেন তিনি। এবং অবশ্যই Chin, Dr Lovita ও বাংলাদেশের মৃনাল বাবু তো ছিলেনই। আরো অনেকেই যাঁরা খবরাখবর নিয়েছেন সকলের নাম উল্লেখ করে দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তবে কৃতজ্ঞতা সকলের প্রতি।

হালিম খেলাম Pista House এর একটা আউটলেটে। এখানে মাটনের মাঝে ডাল ঝোল খুঁজলাম। ডালের মাঝে মাটন নয়। অপূর্ব তার স্বাদ। ভারত ছাড়াও তাদের আউটলেট রয়েছে ওমান, কাতার, আমেরিকায়। বিরিয়ানি খেলাম Paradise Biryani তে। বেশ খেলাম। Al Saba রেস্তোঁরায় খেলাম রুমালি রুটি আর মাটন এর একটা পদ। স্বাদ লেগে আছে জিভে। কাবাব খাবার সময় মিলল না। ফের মিলবে কোনদিন।

এর মাঝেই একটা দিনের অর্ধেকটা সময় জুড়ে খানিকটা ঘোরাঘুরি করতে পারলাম। ভারত স্বাধীন হবার পরও যে কয়েকটি রাজা / বাদশাহ শাসিত অঞ্চল স্বাধীন ছিল নিজাম শাসিত হায়দ্রাবাদ তার অন্যতম। মূল্যবান ধন রত্নের মালিকানা আর বিপুল ভূসম্পত্তির মালিকানার কারণে নিজামকে বলা হোত একসময় পৃথিবীর সবচাইতে ধনী রাজা। ইতিহাস প্রসিদ্ধ ভূখণ্ড। ইতিহাসের অমোচনীয় দাগ রয়ে গেছে এই জনপদে। সে আলাপ আরেক সময়। গোলকান্দা ফোর্ট দেখা হোল। প্রায় সব দুর্গের মতই বিশাল প্রস্তর দেয়াল, গেট, প্রতিরক্ষা আয়োজন। গেলাম চার মিনার। চারটি বিশালাকৃতির মিনারকে ঘিরে কয়েক কিলোমিটারের এক ব্যস্ত বিপণীকেন্দ্র। ‘হাজারে হাজারে মানুষ বাজারে’ যেনবা। ঘুরে এলাম হোসেন সাগর। মনুষ্য নির্মিত হ্রদ। প্রায় চার বর্গকিলোমিটার এর কম নয়। চারপাশে দারুণ সুন্দর ওয়াকওয়ে। ভারতের সব মনীষা আর মনীষী’র স্ট্যাচু তার তীর ঘেঁষে। হ্রদের মাঝে একখন্ড দ্বীপে বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি অখন্ড গ্রানাইটের।

পুরনো হায়দ্রাবাদ ঘিঞ্জি। নয়া হায়দ্রাবাদে আলোর রোশনাই। আকাশ ছোঁয়া ভবন। আলো ঝকঝকে। ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেস ওয়ে, পরিকল্পিত সবুজ। প্রযুক্তি ছুঁতে চাইছে সর্বত্র। বড় সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী। হাজারে হাজারে বাইক, প্রাইভেট গাড়ি। তুলনায় গণ পরিবহন মানে বাস কম বলেই লনে হল। তবে মেট্রোরেল ছুটছে। চন্দ্রবাবু নাইডুর ড্রিম শহর আর অন্ধ্র রাজ্যের নয়। এটা এখন তেলেঙ্গানা রাজ্য।

আহা সেই তেলেঙ্গানা। লাল আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে ওঠেছিল যে রাজ্যে। ভারতের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরেই তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছিল বামপন্থীরা। প্রায় সমান্তরাল গ্রাম সরকারের জন্ম দিয়েছিল চাষীরা। বড় ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে, সামন্ত জমিদারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভারতের মুক্তির সংগ্রামে অঙ্গীকারাবদ্ধ মানুষের সামনে যে লড়াই এখনো আলোকবর্তিকা। অথচ, কী পরিতাপের বিষয়। একটা স্ট্যাচু খোঁজ করলাম হায়দ্রাবাদ শহরে তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের। পেলাম না। তেলেঙ্গানা নামের আলাদা রাজ্য গড়ে তুলতে প্রাণ দেয়া তিন শতাধিক শহীদ স্মৃতি স্মারক আছে। স্বাধীন ভারতের মহাবিদ্রোহের চিহ্ন মাত্র রাখা হয়নি। আজ এক অটো রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহের কথা। সে নিজাম চেনে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা লন্ডনে, সে খবর রাখেন। কিন্তু, মহাবিদ্রোহের মহাযজ্ঞের নির্মাতা অগ্রজদের খবর রাখেন না। দুঃখই পেলাম।

তবে, ভোজন রসিক হায়দ্রাবাদ, হাইটেক সিটি হায়দ্রাবাদ, চিকিৎসার হায়দ্রাবাদ, ঐতিহাসিক স্থাপনার হায়দ্রাবাদ, সংগ্রামে জ্বলে ওঠা হায়দ্রাবাদে আসতেই হবে আবার।

১ এপ্রিল, ২০২৩